করোনার ক্রান্তিকালে সৃষ্ট প্রকট পুঁজি সংকট, রং, সুতার অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি, উৎপাদন বন্ধ ও উৎপাদিত তাঁতবস্ত্র বিক্রি না হওয়ায় দেশের তাঁতশিল্পের কেন্দ্রবিন্দু সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প মহাসংকটে পড়েছে। গেলো বছর লকডাউনের শুরুতে শাহজাদপুরের সব তাঁত কারখানা আর কাপড়ের হাট টানা ৪/৫ মাস বন্ধ ছিলো ও পরবর্তীতে দীর্ঘমেয়াদী বন্যার কবলে ক্ষতিগ্রস্থ তাঁতীরা পুঁজি হারিয়ে ব্যাপক লোকসানের মুখে দিশেহারা হয়ে পড়ে ।
সেই ক্ষতি আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি তারা। তাঁতবস্ত্র ব্যবসায়ের ভরা মৌসুমে এরই মধ্যে ফের লকডাউনে পড়ে শাহজাদপুরের প্রায় ১ লাখ তাঁতী ও শ্রমিকেরা তাদের জীবন জীবীকার প্রশ্নে চোখেমুখে রীতিমতো সর্ষের ফুল দেখছে। গেলো বছর ঈদ, পহেলা বৈশাখ ও পুঁজায় এবং চলতি বছরেও পহেলা বৈশাখ ও আসন্ন রমজানের ঈদকে উপলক্ষ করে তাঁতবস্ত্রের বেচাকেনায় মারাত্বক ধ্বস নামায় কোমড় ভেঙ্গে গেছে এলাকার সিংহভাগ তাঁতী ও মহাজনদের। তাঁতসমৃদ্ধ শাহজাদপুরসহ সিরাজগঞ্জে উৎপাদিত তাঁতবস্ত্র দেশে তাঁতবস্ত্রের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করে আসলেও করোনার প্রভাবে তা মুখ থুবড়ে পড়েছে।
করোনার ক্রান্তিকালের আগেও শাহজাদপুরের তাঁতপল্লীতে তৈরি শাড়ি, লুঙ্গি ও গামছার ব্যাপক চাহিদা ছিলো দেশবিদেশ জুড়ে। এখন নেই আর সেই চাহিদা ও কদর। নেই তাঁতপল্লীর খট্খট্ শব্দ আর লাখ লাখ তাঁতী ও শ্রমিকের কর্ম প্রাণচাঞ্চল্যতা।
পুঁজি সংকট কাটিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ কুটিরশিল্প তাঁতশিল্পের ঐতিহ্য ধরে রাখতে আর রুটিরুজি নিশ্চিতে এখনই সরকারের কার্যকর উদ্যোগ দেখতে চায় এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ তাঁতী ও শ্রমিকেরা।
স্থানীয় তাঁতী ও মহাজনেরা জানায়, দেশের তাঁতশিল্পের কেন্দ্রবিন্দু সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে প্রায় ৩ লাখ তাঁতী ও শ্রমিকের বসবাস। বছরখানেক আগেও শাহজাদপুরের তাঁতপল্লীতে প্রায় ১ লাখ পাওয়ার লুম ও ৫০ হাজার হ্যান্ডলুম সচল থাকলেও করোনাসহ নানা সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ৮০ হাজার তাঁত। ফলে বেকার হয়ে পড়েছে প্রায় ১ লাখ তাঁতী ও শ্রমিক। অন্য কোন কাজ না জানায় বেকার এসব তাঁতী ও শ্রমিকেরা পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর দিনযাপন করছে।
পুঁজি হারানো তাঁতীদের অনেকেই পরবর্তীতে ধারদেনা ও ব্যাংক ঋণ নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও তাদের সব প্রচেষ্টা বিফলেই রয়ে গেছে। তাদের অভিযোগ, তুলার দাম বৃদ্ধির অজুহাতে সকাল-বিকাল সব কাউন্টের সুতার দাম বাড়াচ্ছে অসাধু সূতা ব্যবসায়ীরা। উচ্চ মূল্যে রং সুতা কিনে কাপড় বানালেও হাটের পাইকারেরা তা বেশি দামে কিনতে নারাজ। দিনের পর দিন এভাবে চলতে থাকায় ইতিমধ্যেই পুঁজি হারিয়ে পথে বসে গেছে অনেকেই। লোকসানের ভার সইতে না পেরে আবার অনেকেই অন্য পেশায় ঝুঁকছে। অনেকে আবার রিক্সা-ভ্যান চালনাসহ নানা পেশায় আত্মনিয়োগ করেছে।
এলাকার বেশ কয়েকজন প্রান্তিক তাঁতী আক্ষেপ প্রকাশ করে জানান, ‘দীর্ঘ সময় ধরে শাহজাদপুরের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প মহাসংকটে রয়েছে। একদিকে, কাচাঁমালের দাম বৃদ্ধি ও অন্যদিকে, উৎপাদিত তাঁতবস্ত্র হাটে বিক্রি না হওয়ায় পুঁজি ভেঙ্গে খরচ করতে করতে পুঁজিশূণ্য হয়ে পড়েছে এলাকার সিংহভাগ তাঁতী ও মহাজন। ফলে বাধ্য হয়ে তারা একের পর এক তাঁত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। এরই মধ্যে কিছু তাঁতী ব্যাংক ঋণ ও ধারদেনা করে পুনরায় তাঁত সচল করলেও উৎপাদিত বস্ত্র বিক্রি করতে না পেয়ে দিনের পর দিন ঋণের অথৈ সাগরে নিমজ্জিত হয়ে প্রতিনিয়ত হাঁ-হুতাশ করছেন। দেশের সর্ববৃহৎ কুটিরশিল্প ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প রক্ষায় কেউ দাঁড়াচ্ছে না তাদের পাশে।থ
স্থানীয় তাঁত শ্রমিকেরা জানান, ‘কাপড়ের হাটে ক্রেতা না থাকায় মহাজন কাপড় বিক্রি করতে পারছেন না। ফলে দিনেদিনে তাঁত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। আগে সপ্তাহে ৭ দিনই কাপড় বুঁনতে পারলেও করোনার ক্রান্তিকালে তদস্থলে সপ্তাহে ৩ দিন কাজ করতে পারছে শ্রমিকেরা। তাও আবার একবেলা কাজ থাকলে অন্য বেলায়ই তা বন্ধ থাকে।
এত কিছুর পরও তাদের মতো চির অবহেলিত, চির পতিত, চির অপাংক্তেয়, যাদের বুক ফাটলেও মুখ ফোঁটেনা, যাদের বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে; এমন হাজার হাজার তাঁত শ্রমিকদের মজুরিও আগের চেয়ে কমিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে এলাকার প্রায় অর্ধলাখ তাঁত শ্রমিক খেয়ে না খেয়ে মানবেতর দিনযাপন করছে।
স্থানীয় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে খেঁাজ নিয়ে এবং তাঁতবস্ত্র ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এনায়েতপুর ও শাহজাদপুর কাপড়ের হাটে প্রতি সপ্তাহের চার দিন (দিনরাত দুথদিন করে) কাপড় বিক্রি হয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপারী পাইকারেরা এ দুথহাটে এসে শাড়ি, লুঙ্গি ও গামছা কিনে থাকেন।
সেইসাাথে শাহজাদপুরের তাঁতপল্লীতে উৎপাদিত তাঁতবস্ত্রের একটা বৃহৎ অংশ প্রতি হাটেই ব্যাক্তিগত উদ্যোগে ভারতে রফতানি হয়ে থাকে। প্রতি হাটে ব্যাংক ও নগদসহ প্রায় ৩/৪ থশ কোটি টাকার লেনদেন হলেও করোনার ক্রান্তিকালে তা প্রায় ৭০ শতাংশের নীচে নেমে এসেছে। আর লকডাউনে পুরোপুরি লেনদেন বন্ধ রয়েছে। সেই সঙ্গে খেলাপী ঋণের সংখ্যাও বেড়েছে।
উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ শাহজাদপুর কাপড়ের হাটের তাঁতবস্ত্র উৎপাদক ও বিক্রেতা আকন্দ টেক্সটাইলের মালিক লিটক আকন্দ বলেন, ‘রং সুতার দাম অস্বাভাবিক মাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁতবস্ত্রের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু উৎপাদিন বস্ত্রের দাম বাড়েনি। হাটে নেই কোনরকম কেনাবেচা। তাঁতবস্ত্র ব্যবসায়ের ভরা মৌসুমে কেনাবেচায় এত করুণ দশা জীবদ্দশায় দেখিনি।
শাহজাদপুর উপজেলা তাঁত শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক পৌর কাউন্সিলর আল মাহমুদ অভিযোগ করে বলেন, ‘করোনার পর থেকে সব পেশাজীবীদের পাশেই সরকারকে দাঁড়াতে দেখা গেলেও শাহজাদপুরে কর্মরত প্রায় ৭০/৮০ হাজার শ্রমিকের পাশে দাঁড়ায়নি কেউ। তাঁতী মহাজনেরা সপ্তাহে ৭ দিনের পরিবর্তে ২/৩ দিন পরপর শ্রমিকদের কাজে নিচ্ছে। তারও একবেলা কাজ করতে দিচ্ছে শ্রমিকদের।
এর পরেও ‘মরার ওপর খাড়ার ঘাথ এর মতো শ্রমিকদের মজুরিও কমিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে শ্রমিকেরা তাদের পরিবার নিয়ে খেয়ে না খেয়ে অতিকষ্টে প্রতিটি দিন কাটাচ্ছে। তাঁতী মহাজন বাঁচলে শ্রমিক বাঁচবে, তাই তাঁতী মহাজনদের বাঁচাতে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার কোন বিকল্প নাই।থ
শাহজাদপুর পাওয়ারলুম এসোসিয়েশনের আহবায়ক তাঁতী মহাজন হাজী নজরুল ইসলাম আক্ষেপের সাথে জানান, ‘রং সুতার দাম বাড়লেও সে অনুপাতে কাপড়ের দাম বাড়েনি। উৎপাদন খরচের চেয়েও কম দামে লোকসানে কাপড় বিক্রি করতে হচ্ছে। ফলে শ্রমিকদের মজুরি ঠিকমতো দিতে পারছি না। তাঁতীদের চরম এ দুরাবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বিকল্প আছে বলে মনে করছি না।
শাহজাদপুর ইয়ার্ণ মাচেন্টস এসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি ও স্থানীয় সূতা ব্যবসায়ী হাজী হায়দার আলী বলেন,‘তুলার দাম বৃদ্ধির অনুপাতে মিলাররা সুতার দাম বাড়ালেও নারায়নগঞ্জের কিছু অসাধু সুতা ব্যবসায়ীরা সে অনুপাতে দাম না বাড়িয়ে ইচ্ছেমতো অস্বাভাবিক মাত্রায় কয়েকগুণে বৃদ্ধি করায় সুতার বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। দ্রুত এটা স্থিতিশীল করা না গেলে এ শিল্পের বিপর্যয় কোন ভাবেই রোধ করা যাবে না।
শাহজাদপুর ইয়ার্ণ মার্চেন্টস এসোসিয়েশনের সাধারন সম্পাদক হাজী রমজান আলী বলেন, ‘রং সুতার দাম বৃদ্ধিতে শাহজাদপুরের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প ধ্বংশ হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা উত্তরণে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি।থ
শাহজাদপুর বিসিক তাঁতবোর্ডের লিয়াঁজো অফিসার আনিছুর রহমান জানান,‘১থশ ৩০ জন প্রান্তিক তাঁতীর মাঝে সহজশর্তে ২৫ কোটি টাকার ঘুর্ণয়মান ঋণ দেয়া হয়েছে। করোনা ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ্য সকল প্রান্তিক তাঁতীদের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপন করে তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে পরবর্তীতে কোন নির্দেশনা আসেনি।থ
শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহ মোঃ শামসুজ্জোহা বলেন, ‘তাঁতীদের মাঝে সহজশর্তে ঋণ দেয়া হয়েছে। তাঁতশিল্পকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে তাঁতবস্ত্রের বিশ্ববাজার সৃষ্টির বিষয়টি পরিকল্পনায় রয়েছে। এ শিল্পকে রক্ষায় থ্রি-পিছের পরিবর্তে তাঁতবস্ত্র পরিধানে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। চোরাইপথে আসা ভারতীয় কাপড় যেন দেশীয় তাঁতশিল্পকে ক্ষতিগ্রস্থ্য করতে না পারে সেজন্য ইতিপূর্বেও অভিযান চালানো হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও চালানো হবে।
বাংলাদেশ স্পেশালাইজ পাওয়ারলুম ইন্ড্রাট্রিজ এ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ও সিরাজগঞ্জ জেলা তাঁত মালিক সমিতির সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব হায়দার আলী জানান, ‘করোনার ক্রান্তিকালে শাহজাদপুরে প্রায় ৮০ হাজার তাঁত বন্ধ হয়ে ১ লাখ তাঁতী ও শ্রমিক বেকার হয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। দীর্ঘসময় ধরে এ সংকট চলমান থাকায় ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প ধ্বংশের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ তাঁতবোর্ড শাহজাদপুরের বিসিক সেন্টার থেকে ক্ষতিগ্রস্থ লক্ষাধিক তাঁতীদের কথা মাথায় না রেখে মাত্র ১৩০ জনের মাঝে ২৫ কোটি টাকার সহজশর্তে ঘুর্ণিয়মান ঋণ দেয়া হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অতি নগণ্য হওয়ায় তাঁতীদের তা তেমন কোন কাজেই আসছে না।
ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পে চলমান মহাসংকট নিরসনপূর্বক তাঁতশিল্পের ঐতিহ্য ফেরাতে পুঁজি সংকট কাটিয়ে বেকার ও ক্ষতিগ্রস্থ তাঁতী ও শ্রমিকদের মধ্যে জরুরী ভিত্তিতে ২ হাজার কোটি টাকার সহজশর্তে মুনাফাবিহীন ঋণ সুবিধা দেয়া হলে তাঁতীরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে ও তাঁতশিল্প ফিরে পাবে হারানো ঐতিহ্য ও গৌরব।
প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের সর্ববৃহৎ কুটিরশিল্প ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পকে ধ্বংশের হাত থেকে রক্ষায় এ বিষয়ে আশু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে এলাকার তাঁতীরা আশায় বুক বেঁধে রয়েছ।