নিজস্ব প্রতিবেদকঃ শীষ বেরোনো ধানখেতের দিকে তাকালে মনটা ভরে উঠছে কৃষকের। এবার ধানের ফলন ভালো হয়েছে।
যেদিকে তাকানো যায়, বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে সবুজের মায়া। মাঝেমধ্যে একটু-আধটু হলুদ-সোনালি রঙের ছোপ আছে, এতটুকুই। এই সবুজ-সোনালি মায়ার দিকে এখন কৃষকের স্বপ্নভরা আশা চোখ। দিন শেষে মাঠের ফসলটুকু ঘরে তুলতে পারলেই তাদের স্বস্তি আাশ পূর্ণ হবে। হাওরপারের মাঠ হলেও বোরো ফসল ঘরে তুলতে পানি নিয়ে ততটা ভয়ডর নেই, যত ভয় এখন ‘পাথর’ নিয়ে তাদের ভয়। শিলাবৃষ্টিকে স্থানীয় ভাষায় ‘পাথর’ বলে। আকাশে মেঘের ঘোর হলেই পাথর বা শিলাবৃষ্টির ভয়ে কৃষকের মন শঙ্কাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।
মৌলভীবাজারের ৭টি উপজেলা-সহ হাওরপারে এ রকমই স্বপ্ন-শঙ্কার মধ্যে সময় পার করছেন বোরোচাষিরা। এবার ধানের ফলন ভালো হয়েছে। শীষ বেরোনো ধানখেতের দিকে তাকালে মনটা ভরে উঠছে কৃষকের। এই সময় (বৈশাখ মাস) তাঁদের কাছে যেমন উৎসবের, তেমনি ফসল গোলায় না তোলা পর্যন্ত ভয়েরও তারা। এ রকমই বুক ধুকপুক করা সময়ের মধ্যেই গোলায় ধান তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন প্রায় সবাই।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আখাইলকুরা ইউনিয়নের কাউয়াদীঘি হাওরপারের গ্রাম কাদিপুরের জ্যোতি সরকার বলেন, এবার ধান ভালা অইছে (হয়েছে)। এবার কোনো জাগাত (খেতে) ধান মরা নায় (রোগাক্রান্ত না)। এই ধান নিয়া পানির বেশি ডর (ভয়) নাই। পানিখাঞ্জিতে ধান যাইতো নায় (পানিতে ধান ডুববে না)। যত উপরর পাথরের ডর (যত ওপরের শিলাবৃষ্টির ভয়)।
তিনি বলেন, বিষ্টি অইছে, পাথরও দিছে। কিন্তু ক্ষতি অইছে না। অখন ধান পাকের (পাকতেছে)। অখনই পাথরর ডর বেশি।
জ্যোতি সরকার জানিয়েছেন, তিনি প্রায় ছয় কিয়ার (১ কিয়ার=৩০ শতক) জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছেন। ব্রি ধান-২৯ এবং জনক রাজ জাতের (মোটা চালের ধান) ধান রোপণ করেছেন। প্রতি কিয়ার (কানি) জমিতে হাল দেওয়া, হালিচারা রোপণ, সার দেওয়া, ধান কাটানোসহ তাঁর আনুষঙ্গিক খরচ পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা।
গত বুধবার বিকেলে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট-একাটুনা সড়ক দিয়ে যাওয়ার পথে সড়কের দুই পাশে যেদিকেই চোখ পড়েছে, সেদিকেই এখন ধানের সবুজ। উত্তরমুলাইম, মল্লিকসরাইসহ কাউয়াদীঘি হাওরপারের বরকাপন, বানেশ্রী, রায়পুর, রসুলপুর, খৈশাউড়া, গল্লা, জুমাপুর, কাদিপুর, দুর্গাপুর, জগৎপুর, কান্দিগাঁও, অন্তেহরিসহ সব গ্রামের মাঠেই বোরো ফসল, সবুজের মায়া ছড়ানো। ধানের খেতে চোখে পড়েছে বেশ কিছু কাকতাড়ুয়া। এখনো ধান পাকেনি। কোথাও একটু-আধটু হলুদ, সোনালি রঙের ছোপ ধরেছে। কোথাও ধানের শীষ বের হয়েছে। কোনো খেতে ধানের ছড়ায় দানা বাঁধছে। কোনো খেতে এখনো শুধুই ধানগাছ বাতাসে দোল খেয়ে নাচছে।
সদর উপজেলার কাদিপুরে একজন কৃষককে জমিতে পাকা ধান কাটতে দেখা গেছে। দূরের কোনো খেত থেকে ট্রাকে করে কাটা ধান নিয়ে বাড়ি ফিরছেন একজন গেরস্ত। সূর্য ডোবার আগমুহূর্তে হাওরের দিক থেকে কাঁধভারে কাটা ধানের আঁটি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন সাত-আটজন কৃষক। কাদিপুর, অন্তেহরিসহ দুই-তিনটি স্থানে দেখা গেছে, সড়কের পাশে, বাড়ির উঠানে ধান সেদ্ধ করা হচ্ছে। দূর থেকে ভেসে আসছিল যন্ত্রে পাকা ধান মাড়াইয়ের শব্দ।
বুধবার সন্ধ্যার মুহূর্তে কাদিপুর ও অন্তেহরির সংযোগস্থলের কালভার্টে দাঁড়িয়ে যখন কৃষকদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন ভ্যাপসা, তাতানো গরমের মধ্যে আকাশে মেঘ ডাকতে শুরু করেছে। এ রকম মেঘ দেখলে, মেঘের ডাক শুনলেই কৃষকের বুকটা ধুকপুক করে ওঠে।
কাদিপুর গ্রামের নিবারণ নমশূদ্র বলেন, দিনর ঘোর খারাপ (আবহাওয়া ভালো নয়)। আমরার এ ধানরতো (বোরো ধান) এক ঘণ্টার বিশ্বাস নাই। আল্লাহ (সৃষ্টিকর্তা) যদি খাওয়ায়। এখনো ধান পাকছে না। হাওরর রং কালা রইছে (ধানের রং সবুজ রয়ে গেছে)। রং ধরছে না (পাকা ফসলের রং ধরেনি)। ধান কাটতে নিচেদি (কম করেও) আরও ৮-১০ দিন লাগবে। কিছু ধানর আরও বেশি লাগবে।
ভানু বিশ্বাস বলেন, ধান তো ভালা অইছে দেখলাম (ভালো হয়েছে দেখতেছি)। কিন্তু এখনো কাঁচা। পাকলে বোঝা যাইব চুছা (চিটা) আছে কি না। অখন (এখন) ভগবানে কাটাইন (কাটান) যদি, তাইলেই ভালা। কোনো নিরাপত্তা নাই। যদি পাথর দেয়, তাইলে সব শেষ। এক বাইন দিছে (শিলাবৃষ্টি একপশলা হয়েছে), কোনো ক্ষতি অইছে না। ভানু বিশ্বাস এ বছর দুই কিয়ার (কানি) জমিতে ব্রি ধান-৯২ জাতের বোরো চাষ করেছেন। এতে কম করেও ৩০ মণ ধান পাওয়ার আশা করছেন তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজার জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সদর ও রাজনগর উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত কাউয়াদীঘি হাওর। মনু নদ সেচ প্রকল্পের আওতায় হাওরপারে সেচের সুবিধা পেয়ে যেসব জমিতে অতীতে বোরো ধান চাষ হয়নি, গত কবছর ধরে কৃষকেরা সেসব জমিতেও বোরো চাষ করছেন। এ বছর সারা জেলায় বোরো ধান আবাদ হয়েছে ৬১ হাজার ৫০ হেক্টর। এবার ব্রি ধান-৮৮, ৮৯ ও ৯২ জাতের ধান বেশি চাষ হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারের উপপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ সামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, ধান কিছু কাটা শুরু হয়েছে। বেশি হচ্ছে হাকালুকি হাওরে। কৃষকেরা হাকালুকি হাওরের চতুর্দিকে কাটতেছে বলে তিনি জানান।