বাঙালী বাংলা সাহিত্য ও বর্ষার সঙ্গে কদম ফুলের নিবিড় সম্পর্কের জন্য বলা হয় বর্ষার ফুলের রাজ্যে রানী কদম ফুল। কদম ফুলের সৌন্দর্যে বিমোহিত হন না এমন বেরসিক মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর। বর্ষায় প্রেমিকার মনোরঞ্জনের জন্য কদম ফুলের জুড়ি নেই। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মনে দোলা দিয়েছে স্বর্ণ রঙিন কদম ফুল। তিনি লিখেছেন-
“দোলে শিহরে কদম,
বিদরে কেয়া,
নামিলো দেয়া।”
জীববিজ্ঞানী ও লেখক দ্বিজেন শর্মা অনন্য এই কদম ফুল সম্পর্কে তাঁর ‘শ্যামলী নিসর্গ’ বইয়ে লিখেছেন ” বর্ণে গন্ধে সৌন্দর্যে কদম এ দেশের রূপসী তরুর অন্যতম”। বর্ষার আগমনী বার্তা নিয়ে আসে কদম ফুল। কদম ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম “Neolamarckia Cadamba” কদম ফুল যেন বর্ষার দূত। আষাঢ়ের সঙ্গে কদমের সম্পর্ক নিবিড়। সাধারণত আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টিতেই কদম ফুল ফোটে। কদম মূলত বর্ষার ফুল হলেও জলবায়ুর পরিবর্তনে আগাম বৃষ্টির কারণে বৈশাখ বা জ্যৈষ্ঠ মাসে তা চোখে পড়ে। বজ্রগর্ভ বৃষ্টির পানি কদমের শিকড়ে পৌঁছলেই এই ফুল ফুটতে শুরু করে।প্রাচীন সাহিত্যের একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে কদম ফুল। গোলাকার সাদা-হলুদ রঙের ফুলটি দেখতে ছোট বলের মতন। সম্পূর্ণ গাছ জুরে এই ফুলের সমাহার ঘটে। সেই মূহূর্তটি এক অপূর্ব সৌন্দর্যের। এছাড়াও বাংলা সাহিত্যে কদম ফুলকে নীপ, বৃত্তপুষ্প, মেঘাগমপ্রিয়, কর্ণপূরক, ভূঙ্গবল্লভ, মঞ্জুকেশিনী, পুলকি, সর্ষপ, লালনাপ্রিয়, সুরভি, সিন্ধুপুষ্প নামে ডকা হয়েছে।
তবে নাম যাই হোক বাংলার বাদল দিনের কদম ফুলের কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে সুন্দর করে আর কে বলেছেন-“বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান,আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান।”
কদম ফুলের আদি নিবাস মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। তবে লাল কদম বাংলাদেশ থেকে এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও উপস্থিতি চোখে পড়ে না। নারায়ণগঞ্জ এর পগলার শাহী মহল্লার জনৈক ফারুক আহমেদের বাড়িতে লাল কদম ফুলের একটি গাছ ছিল। এছাড়াও আমার জানামতে গাজীপুরের জয়দেবপুরে ও বরিশালে একটি করে লাল কদম ফুলের গাছ ছিল। বিশ্বের নানা দেশে কদম গাছ দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, ভারত, মালয়ে, নেপাল, শ্রীলংকা, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, অস্ট্রেলিয়ায় এই কদম ফুলের গাছ রয়েছে। কদমের সংস্কৃত নাম কদম্ব।
প্রচীন বাংলা সাহিত্যের বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে কদমফুল। মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্য জুড়ে রয়েছে কদমের সুরভীমাখা রাধা-কৃষ্ণের বিরহগাথা। ভগবত গীতা থেকে শুরু করে লোকগাথা, পল্লীগীতি, রবীন্দ্র কাব্যে পর্যন্ত কদম ফুলের উল্লেখ রয়েছে। ভানুসিংহ, পদাবলী, বৈষ্ণব পদাবলী ও শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে নানাভাবে নানা আঙ্গিকে এসেছে কদম ফুলের কথা। কদম ফুল নিয়ে গ্রাম বাংলার নানা ছড়া-কবিতাও রয়েছে-
“চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে
কদম তলায় কে,
হাতি নাচছে ঘোড়া নাচছে
সোনা মনির বিয়ে।”
কদমগাছ বৌদ্ধ ধর্মের একটি পবিত্র গাছ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে জড়িত কদম গাছ। শ্রীকৃষ্ণের লীলা খেলা থেকে শুরু করে রাধাকৃষ্ণের বিচ্ছেদ সব কিছুতেই রয়েছে কদম গাছের উল্লেখ। কদম গাছ দীর্ঘ আকৃতির এবং বহু শাখা বিশিষ্ট উদ্ভিদ। রূপসী তরুর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কদম গাছ। কদমের গাছ সরল উন্নত ধূসর থেকে প্রায় কালো এবং বহু ফাটলে রুক্ষ কর্কশ। কদমের পাতা হয় বড় বড় ডিম্বাকৃতি উজ্জ্বল সবুজ তেল চকচকে। নিবিড় পত্রবিন্যাস এর জন্য কদম ছায়াঘন একটি গাছ। গাছের উচ্চতা ৪০ থেকে ৫০ ফুট পর্যন্ত হয়।
শীতে কদমের এর পাতা ঝরে এবং বসন্তের কচি পাতা গজায়। কদমের কচি পাতার রং হালকা সবুজ। কদমের একটি পূর্ণ মঞ্জুরি কে সাধারনত একটি ফুল বলে মনে হলেও তা মূলত বর্তুলাকার মাংসল পুষ্পাধারে অজস্র সরু সরু ফুলের বিকীর্ণ বিন্যাস । কদম ফুল দেখতে বলের মত গোল সাদা হলুদ। তবে পাপড়ি ঝরে গেলে শুধু হলুদ রঙের গোলাকার বল এর মত দেখা যায়।
গাছের ফল খুব মাংস সমৃদ্ধ টক যা বাদুড় ও কাঠবিড়ালির প্রিয় খাদ্য। ফুলে ফুলে ভরা কদম গাছ দেখতে অসাধারণ সুন্দর লাগে। তবে কদম গাছ কেউ গুরুত্ব দিয়ে লাগায় না প্রাকৃতিক ভাবেই গাছগুলো এমনিতেই হয়ে ওঠে। কদমের কাঠ নরম বলে তেমন একটা আসবাবপত্র তৈরি করা যায় না।কাঠ দিয়ে দিয়াশলাইয়ের কাঠি ও বাক্স-পেটরা তৈরি করা হয়ে থাকে। কদম গাছের ছাল জ্বরের ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পাতার রস ছোটদের কৃমির জন্য খাওয়ানো হয়। ছাল ও পাতা গুরুত্বপূর্ণ ব্যথানাশক ঔষধ।কোন কোন অঞ্চলে আবার কদমফুল তরকারি হিসেবে রান্না করে খাওয়া হয়। ধীরে ধীরে প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে কদম ফুল।
এক সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় প্রচুর কদম ফুলের গাছ চোখে পড়তো। বর্তমানে যান্ত্রিক সভ্যতা ও নগরায়নের যুগে মানুষের সামান্য প্রয়োজনে কদম গাছ কে তুচ্ছ মনে করে কেটে ফেলা হচ্ছে। কদম ফুল ছাড়া বর্ষা একেবারেই বেমানান। প্রকৃতির ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারি উদ্যোগে অন্যান্য গাছের পাশাপাশি কদম গাছ রোপন করা প্রয়োজন।