সামরিক মর্যাদায় মেজর অব. ওয়াকি উজ্জামানের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর অব.আলী ওয়াকি উজ্জামানকে সামরিক মর্যাদায় সিলেটের শাহজালাল (র.) এর দরগায় দাফন করা হয়েছে।
শুক্রবার বাদ আছর দরগা মসজিদে নামাজে জানাযা শেষে তাঁকে কর্ণেল আমিন এর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি চৌকস দল আলী ওয়াকি উজ্জামানকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এছাড়া সেনা প্রধানের পক্ষ থেকে মরহুমের কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। এসময় বিউগলে করুন সুর বাজিয়ে সেনাবাহিনীর এই সহকর্মীর প্রতি অশ্রুসিক্ত শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সেনা অফিসাররা।
এর আগে সিলেট জেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের এই বীর যোদ্ধাকে পৃথক গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এসময় সিলেটের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন এর নেতৃবৃন্দ, আত্মীয়, শুভাকাঙ্ক্ষী ও সাধারণ মানুষ তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
মেজর অব. আলী ওয়াকি উজ্জামান বার্ধক্যজনিত অসুস্থ অবস্থায় গত কয়েকদিন যাবত সিলেট নগরীর আল-হারামাইন হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত পৌঁনে ২ টার দিকে শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেন।
মরহুমের মৃত্যুতে সিলেটজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন থেকে পৃথক ভাবে শোক প্রকাশ, মরহুমের বিদেহী আত্মা শান্তি কামনা ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
মেজর অব. ওয়াকির বর্ণাঢ্য জীবনঃ মেজর আলী ওয়াকিউজ্জামান ১৯৪৯ সালের ১৩ এপ্রিল ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যশোর মিশনারী স্কুলে প্রথম শিক্ষাজীবন শুরু করেন। পিতা সুবেদার মেজর (অব.) নাইমুজ জামান চৌধুরী পাকিস্তানি আর্মি জুনিয়র অফিসারের চাকুরির সুবাদে তিনি চট্টগ্রাম ফৌজদারহাট ক্যান্টমেন্ট স্কুল, কক্সবাজার সরকারি হাইস্কুল, ফতেহাবাদ হাইস্কুল চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ক্যান্ট. স্কুল এবং পরবর্তীতে রাওয়ালপিন্ডি (চাকলালা) সেন্ট্রাল গভর্মেন্ট স্কুলে পড়াশোনা করেন। কুমিল্লা ক্যান্ট, স্কুল থেকে এসএসসি, রাওয়ালপিন্ডি গভর্মেন্ট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং সেখান থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন।
১৯৭১ এর ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মেজর ওয়াকি ৪ নম্বর সেক্টরের কৈলাশ শহর সাব সেক্টরের সাব সেক্টর হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। (কৈলাশ শহর যুদ্ধ পরবর্তিতে মৌলভীবাজার সাব সেক্টর হিসেবে নামকরণ হয়) মৌলভীবাজার, কুলাউড়া, রাজনগর, শমসেরনগর ও ভারতের কৈলাশ শহর এলাকায় বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কৈলাশ সেক্টরে যোগদানের পর থেকে বিজয় দিবস পর্যন্ত তিনি কুলাউড়ার শরিয়তপুর ইউনিয়নের ন’মৌজা দখলে রাখতে সক্ষম হন। ভূ কৌশলগত কারণে ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের অনুরোধ ছিল, কোনো মূল্যে নমৌজা দখল রাখতে যাতে পাকিস্তানিদের সামরিক তৎপরতায় ভারতীয় সীমান্ত শহর কৈলাশ শহর অচল না হয়ে পড়ে। নমৌজা এলাকায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন ও দখল রাখার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এত বড় এলাকা মুক্ত রাখার জন্য বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ বীরত্বপূর্ণ ভূমিকায় কারণে তৎকালীন লে. আলী ওয়াকিউজ্জামান ভারতীয় বাহিনীর প্রশংসা অর্জন করে। মুক্তিযুদ্ধের ৪নং সেক্টর কমান্ডার চিত্ত রঞ্জন দত্ত যুদ্ধ পরবর্তি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন- নয়টা গ্রাম নিয়ে গঠিত একটি মৌজা-নাম নমৌজা। এটি ভারতের কৈলাশ শহরের বিপরীতে
অবস্থিত ছিল। লে. ওয়াকিউজ্জামানের নেতৃত্বে নয়মৌজায় পাকিস্তানি খাটির উপর আঘাত হানা হলো এবং নমৌজাকে শত্রুমুক্ত করা হলো। এমনিভাবে পুরাছড়া, কাড়াবালা, মোকামটিলা, আমলসিদ, নমৌজা আমাদের দখলে আসে এবং পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তানিদের উপর আঘাত হানা হলো এই সমস্ত ঘাঁটি হতে।
একই সাথে মুক্তিবাহিনী সংগঠিত করা ও আঞ্চলিক পর্যায়ে সফল নেতৃত্ব দিয়ে মিত্র বাহিনীর ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশ গঠনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আহবানে তিনি প্রথমে বাংলাদেশ গণবাহিনীর সদস্য হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন্ড লাভ করেন। কমিশন্ড পাওয়ার পর তিনি ৪ নম্বর সেক্টরের কৈলাশ শহর সাব সেক্টরে সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যোগ দেন। এই সাব সেক্টরটি সেক্টর হেড কোয়ার্টার মাছিমপুর, শিলচর (ভারত) অনেক দূর হওয়ায় সেক্টর হেড কোয়ার্টারের কোন সাহায্য বা কোনো নির্দেশনা না পেয়ে নিজের সাব সেক্টরটি পরিচালনা করতে হয়। এবং ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও প্রয়োজনীয় আর্টিলারি গোলাবর্ষণের সাহায্য নিতে হয়। ১৮ বেঙ্গল রেজিমেন্ট’র প্রতিষ্ঠিাতা অ্যাডজুটেন্ড ও প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এছাড়া, ১৯৭২-৭৩ সালে সৈয়দপুর ১৭ বেঙ্গল রেজিমেন্ট’র কোয়ার্টার মাস্টার নিযুক্ত হন। এসময় তিনি নওগাঁ জেলার আত্রাই এলাকায় নকশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিক সফল অভিযান চালিয়ে তাদের দমন করেন। ১৯৭৪ সালে যশোর ১২ বেঙ্গল রেজিমেন্ট’র অধীন কমান্ডো ট্রেনিং সম্পন্ন করেন। এসময় শিপাহী বিপ্লব দমনে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এ সংযুক্ত করা হয় তাঁকে। রংপুর ২৪ বেঙ্গল রেজিমেন্ট’র উপ-প্রধান অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। পরে তিনি সৈয়দপুর আর্মি এডুকেশন এডমিনিষ্ট্রেশন স্কুল এর প্রশিক্ষকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
সাবেক প্রসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হত্যাকান্ডের পর
১৯৮৩ সালে সেনাবাহিনী থেকে বেড়িয়ে এসে বেসরকারি চাকুরি জীবন শুরু করেন। ব্যক্তি জীবনে ২ পুত্র সন্তানের জনক মেজর আলী ওয়াকিউজ্জামান বিশ্বখ্যাত মিটসুবিশি গ্রুপ, হুন্দাই, অক্সিডেন্টাল, বাংলাদেশ এ্যারোমা টি এবং মৃত্যুর শেষদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি খাতের নিরাপত্তা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এলিট ফোর্সের নির্বাহী পরিচালক এর পদে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করলে কনিষ্ঠ ছেলে আলী ওয়াসিমুজ্জামান চৌধুরী রণী ও স্ত্রী ফৌজিয়া জামান সমেত যুক্তরাষ্টে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বড় ছেলে আলী ওয়াসিকুজ্জামান চৌধুরী অনি এলিট ফোর্স এর সিলেট বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন।
Post Views: 127