গোলপাতা গাছের ফলওয়ালা ডাঁটি থেকে বেরিয়ে আসে মিষ্টি রস।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় মঙ্গলবার হাটবারে বিশেষ আকর্ষণ গোলপাতার গুড়। উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নবীপুর গ্রামে কৃষকরা প্রতিদিন সকাল হলেই রস সংগ্রহ করতে ছুটে যায় গোলবাগানে। আর ব্যস্ত হয়ে পড়ে ওইসব কৃষক পরিবারের গৃহবধূরা। কেউ কলস কিংবা বালতি নিয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ রস ভর্তি কলস বালতি নিয়ে বাড়ি ফিরছে। কেউ কেউ সংগৃহীত রস বাড়ির উঠানে নিয়ে আসছেন। আর সেই রস গৃহবধূরা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ছেঁকে ঢোঙ্গায় রাখছেন। এরপর তারা তাফালে খড়কুটা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে রস দিয়ে তৈরি করেন গুড় বা মিঠা। নাম গোলগাছ হলেও দেখতে কিছুটা নারিকেল পাতার মতো।
এটি দক্ষিণাঞ্চলের অর্থকারী ফসল। গোলপাতার গাছ স্বল্প ও মধ্যম লবণাক্ত অঞ্চলে জন্ম, নোনা সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। অথচ এর ফলওয়ালা ডাঁটি থেকে বেরিয়ে আসছে মিষ্টি রস। সেই রস দিয়ে তৈরি হচ্ছে গুড় (মিঠা)।স্বাদের পাশাপাশি গোলের গুড়ের ঔষধিগুণ আছে। সুস্বাদু এই গুড়ের চাহিদাও রয়েছে ব্যাপক। প্রতি বছর শীত মৌসুমে প্রতিদিন সূর্য ওঠার সাথে সাথে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় প্রায় শতাধিক কৃষক ব্যস্ত হয়ে পড়ে এ গাছের রস সংগ্রহ করতে। এরপর বাড়ির উঠানে বসে শুরু হয় রস দিয়ে গুড় তৈরির কাজ। আর সেই গুড় স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে চলছে এলাকার কৃষকদের জীবন-জীবিকা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দেশের সর্ববৃহৎ বনাঞ্চল সুন্দরবনসহ দক্ষিণ উপকূলের বিভিন্ন স্থানে গোলগাছ রয়েছে। তবে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া, কুয়াকাটা, রাঙ্গাবালি, গলাচিপা, দশমিনা, বাউফল, বরগুনার আমতলী, তালতলী, পাথরঘাটা, ভোলা ও খুলনা জেলার বিস্তীর্ণ এলাকাসহ চরাঞ্চলে গোলগাছের বাগান রয়েছে। শীত মৌসুমে গোলবাগানের মালিকরা এর রস দিয়ে গুড় উৎপাদন করে বাড়তি অর্থ উপার্জন করে থাকেন।
সংশ্লিষ্ট গোল গাছের মালিকরা জানান, প্রতিটি গোলগাছ পাতাসহ উচ্চতা হয় ১২ থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত। এর ফুল হয় হলুদ এবং লাল বর্নের । ফুল থেকে গাবনা পরিপক্ব হলে সেটি তালগাছের আঁটির মতো কেটে শাস খাওয়াও যায়। এটি প্রকৃতি নির্ভর পাম জাতীয় উদ্ভিদ। এসব গাছ নদী কিংবা খালের পাড়ে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয়। তবে গোলগাছ চাষাবাদ অত্যন্ত লাভজনক, সহজসাধ্য এবং ব্যয়ও খুব কম। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োজন হয় না। এতে কোনো পরিচর্যাও করতে হয় না। এক সময় এ উপজেলার বিভিন্ন খাল-বিল ও নদীর তীরে প্রচুর গোলের বাগান দেখা যেত। কিন্তু জলবায়ুর প্রভাবজনিত কারণ ও প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ আর চাষাবাদের অভাবে এ গাছ ক্রমশই ধ্বংস হতে বসেছে। গৃহবধু সুনিতি রানী বলেন, বিয়ের পর থেকে গোলের রস দিয়ে গুড় তৌর করছি। আগে অনেক বেশি গুড় হতো। এখন কমে গেছে। অপর এক গৃহবধূ বিথীকা রানী বলেন, এখন রস জ্বাল দিতে হবে। এখন কথা বলার সময় নেই। একটু বসতে হবে।
নবীপুর গ্রামে গোল গাছ চাষি নিঠুর হাওলাদার বলেন, তার বাগান থেকে প্রতিদিন ৪ কলস রস বের হয়। এতে মোট ১৩ কেজি গুড় আসে। প্রতিদিন কাক ডাকা ভোরে উঠে কলস নিয়ে বাগানে যেতে হয়। এরপর প্রতিটি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে আনতে হয়। অগ্রহায়ণ মাস থেকে শুরু হয়ে চৈত্র মাস পর্যন্ত রস সংগ্রহের কাজ চলবে। একই গ্রামের মনিন্দ্র শিকারী বলেন, গোলগাছের গুড়ের স্থানীয় বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ উপজেলায় শতাধিক পরিবার গোলগাছের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
উপজেলা বন বিভাগের কর্মকর্তা আব্দুস সালাম জানান, এ উপজেলার চাকামইয়া, নীলগঞ্জ ও টিয়াখালীর ইউনিয়নের লোন্দা গ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে গোলগাছের বীজ রোপণ করা হয়েছে। এতে ব্যাপক সফলতা পেয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।