বিপ্লবী প্রেরণায় বাংলা মায়ের ভাষা
——————————————————-
জুলফিকার বকুল শিক্ষক, ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি স্কুল, গাজীপুর।
——————————————————
একুশ মানেই জাগ্রত চেতনার নিরবচ্ছিন্ন প্রতিধ্বনির এক মহা প্রেরণার অনুভূতি। যে অনুভূতিতে দেশমাতার কণ্ঠ নিঃসৃত মধুর বাণীতে অস্তিত্বের শেকড় হয় সুদৃঢ় ও সুদূরপ্রসারী।বাংলার দামাল ছেলেরা রক্ত দিয়েছে, নিজেকে উৎসর্গ করেছে কিন্তু বিনিময়ে মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। কতটা গভীর প্রেম আর কতটা আত্মিক টান মানুষকে অকাতরে মৃত্যু মুখে পতিত করে তার জলন্ত প্রমান বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখেছে। মাতৃভাষার জন্য এত রক্ত ঝড়াতে পারে তো তারাই,যারা একমাত্র দেশ ও মাটিকে অন্ধের মত ভালবাসে।এমন নজির পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি কোন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি।বাঙালি বীরের জাতি। যারা রাইফেল আর মেশিনগানের সামনে উন্মুক্ত বুকে দেশপ্রেমের অন্তরাশক্তি নিয়ে নির্ভয়ে তেজদীপ্ত যোদ্ধায় হয়ে যায় রণতূর্য।
৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শুরু হয় বিদ্রোহ। শুরু হয় অন্যায়,অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র সংগ্রাম। শুধু বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মায়ের মুখের ভাষাকে আত্মমর্যাদায় অবিচল রাখা হয়।
আর সে দিনের স্বতন্ত্র মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠাই একটি স্বতন্ত্র জাতি ও রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় এবং বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কার্যত পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি। মায়ের ভাষার অবমাননা ও অমর্যাদা কি আর সন্তানরা মেনে নিতে পারে! প্রায় ২ হাজার কিলোমিটারের অধিক দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের সাথে সাংস্কৃতিক, ভৌগলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান ছিল। তাই জোর করে চাপিয়ে দিয়ে কখনও কারো বাক স্বাধীনতাকে হরণ করা যায় না। তাছাড়া বাংলার মাটির স্নিগ্ধ সুবাস প্রকৃতির মত বাঙালির অঙ্গজুড়ে রয়েছে, সিক্ত মাটির কৈশিক কণিকায় মিশে আছে বাংলার খেটে খাওয়া মানুষের দেহের পরশ। প্রকৃতির সাথে এ এক অবিচ্ছেদ্য মহামিলন। কোন অপশক্তিই এ নাড়ীর টানকে ছিন্ন করতে পারেনা। হয়ত পারে রক্তের বন্যায় মায়ের আঁচলকে রঞ্জিত করতে।
একুশে’র করুণ ইতিহাস প্রতিটি মূহুর্তে প্রতিটি প্রজন্মের মাঝে দেশপ্রেমের জন্ম দেয়। সালাম,জব্বার,রফিক,বরকতরা কখনও মরে না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চির জাগ্রত রয়। যে জাগ্রত চেতনা মুক্তিযুদ্ধে সংগ্রামী বিপ্লব রুপে প্রতিফলিত হয়েছে। লক্ষ জনতা ভাষা সৈনিকদের ত্যাগী প্রেরণা বুকে লালন করে নিজেকে উৎসর্গ করেছে।আমরা পেয়েছি লাল সবুজের উড়ন্ত স্বাধীনতা।
ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য শুধু ব্যাখ্যায় ক্ষ্যান্ত না হয়ে অস্থিমজ্জায় ধারণ ও লালিত হোক। যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এক বীজমন্ত্রে উজ্জীবিত করুক বাঙালির চির ভাস্কর সত্তাকে। ভাষা ও জাতির মর্যাদা সমুন্নত রাখতে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতিসত্তায় ৫২ এর অসীম ও দৃঢ় প্রত্যয় প্রদীপ্ত শিখা হয়ে জ্বলে থাক যুগ থেকে যুগান্তরে। ১৮ কোটি বাঙালির প্রাণের ভাষা হোক সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ। চির উন্নত শিরে বিশ্ব মানচিত্রে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হোক বাঙালির বাংলা।