এক হাত এক পা নিয়েই ভুমিহীন ও পুঙ্গ মিজান প্রতিবন্ধী সন্তান ও স্ত্রীসহ টানছেন ৫ সদস্যের সংসার ঘানি। ত্রিশ বছরেও সরকারের পক্ষ থেকে পায়নি তেমন কিছুই। মেলেনি আশ্রয় প্রকল্পের একটি ঘর। থাকেন রাস্তার পাশে কাগজের তৈরি একটি ঝুপড়ি ঘরে।
পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার খানমরিচ ইউনিয়নের মাদার বাড়ীয়া গ্রামের মৃত জব্বর আলী ফকিরের ছেলে মিজানুর। ১৭ বছর বয়সে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় বাঁ হাত ও বাঁ পা কাটা পড়ে তার। এতে তরুণ বয়সেই পঙ্গু হন তিনি। এর কিছুদিন পরেই তার বাবাও মারা যান। এ অবস্থায় তাকেই সংসারের হাল ধরতে হয়। তখন থেকেই শুরু হয় জীবনযুদ্ধ।
রাস্তার পাশে তিন ছেলে ও এক প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে একটি ঝুপড়ি ঘর করে বসবাস করছেন। জীবন যুদ্ধে হার না মানা মিজানুরের জীবন গাড়ি চলছে থেমে থেমে। ছেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত মিজান ও তার স্ত্রী। বড় ছেলে ইয়াদুল ইসলাম এর বয়স মাত্র ১১ বছর। মেজ ছেলে রাজিকুল ইসলাম (৮) ও ছোট ছেলে রাজিবের বয়স ২ বছর এবং ৫ বছরের মেয়ে আজমিরা প্রতিবন্ধী।
খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান, শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও এই পরিবারে তা দেখা যাচ্ছেনা। সব কিছুই থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে তারা। দেখেও যেন চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন জনপ্রতিনিধিরা। নজর পড়ছেনা উপর মহলেও।
অন্যের জমির কৃষিপণ্য ঘোড়ার গাড়িতে বহন করে যা আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চলে পঙ্গু মিজানের। প্রতিদিন গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা ইনকাম তার। কখনো দিনের পর দিন আবার কখনো মাসেও কাজ মেলেনা। গত এক মাস হলো কোনো কাজ মিলেনি তাদের। খেয়ে না খেয়ে দিন পার হচ্ছে। শেষ সম্বল বলতে তিনটি ঘোড়া ছাড়া আর কিছুই নেই।
প্রতিবেশীরা তাদের কষ্টে ব্যথিত হলেও জনপ্রতিনিধিরা তা দেখেও যেন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। প্রতিবেশী রেবেকা খাতুন বলেন, এই ঘোড়া ওয়ালা খুব কষ্ট করে সংসার চালাচ্ছে। বাড়ি ঘর নেই তাদের। রাস্তার পাশে কাগজ দিয়ে ঘর করে থাকছে। দুই দিন হলো বৃষ্টি হচ্ছে। এতে তাদের থাকার অসুবিধা হচ্ছে। চার ছেলে মেয়ে সবাই শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারি ভাবে তাদের সাহায্য সহযোগিতা খুব প্রয়োজন। আর কিছু না হোক তাদের একটা থাকার ঘরের ব্যবস্থা করে দিলেও তারা উপকৃত হবে।
পঙ্গু মিজানুর রহমান বুকভরা কষ্ট নিয়ে বলেন, আমি সরকারি ভাবে সাহায্য সহযোগিতা পাইনি গত ৩০ বছরে। ১৯৮৮ সালে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় আমার হাত পা কাটা পরে। আমার মেয়েটা প্রতিবন্ধী। ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে যাযাবর এর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমাদের জীবনের আর কয়দিনই বা বাকি আছে। যদি ছেলে মেয়ের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছু করতেন তাহলে মরেও যেন শান্তি পেতাম। বলেই কাঁদতে থাকে পঙ্গু মিজানুর রহমান।
মিজানুর রহমানের বড় ছেলে ইয়াদুল ইসলাম বলেন, আমার বাবা পঙ্গু মানুষ। আমাদের ঘর বাড়ি নাই। ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে খাই। কোনো রকম আমরা খেয়ে না-খেয়ে বেঁচে আছি। আমাদের থাকার খাওয়াই কষ্ট পড়াশোনা করবো কিভাবে। সরকার যদি একটা ঘর দিতো আমরা একটা রাতে ঘুমাতে পারতাম।
পঙ্গু মিজানুরের স্ত্রী বলেন, কত চেয়ারম্যান, মেম্বার হলো কেউ আমাদের দিকে তাকালো না। স্বামীর এক হাত এক পা নেই পঙ্গু মানুষ। কারও কাছে হাত পাততে পারিনা। তাই পরিবারের সবাই মিলে ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে সংসার চালাচ্ছি। আমাদের কোনো ঘড় বাড়ি নেই। যা ছিলো স্বামীর চিকিৎসায় সব শেষ হয়ে গেছে। যদি সরকার আমাদের একটা থাকার ঘর করে দিতো তাহলে ছেলে মেয়েকে নিয়ে একটু হলেও ভালো থাকতে পারতাম। ঝড় বৃষ্টির দিন আসছে। এভাবে কাগজের ভিতরে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাদের একটু সাহায্য করেন।
এবিষয়ে খানমরিচ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. মানোয়ার হোসেন খান মিঠু বলেন, বিষয়টি আমারও নজরে এসেছে। আমি নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান এখনো দায়িত্ব বুঝে পাইনি। আমি এই পরিবারের পাশে অবশ্যই দাঁড়াবো৷
এবিষয়ে ভাঙ্গুড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাম্মদ নাহিদ হাসান খান বলেন, আমার এমন ঘটনা জানা ছিল না। ওই পরিবার থেকে যদি আবেদন করেন। তাদের কি কি নাই এবং কি ধরনের সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন। তবে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খোঁজ নিয়ে। যাচাই-বাছাই করে তাকে যে ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করা যায় তার সব কিছুই করা হবে।