তিন বছর আগের কথা। হঠাৎ করেই নিজের এক একর জমিতে ২৮৪ টি মাল্টার চারা রোপণ করেন কৃষক আমিরুল ইসলাম। তাঁর এ কাণ্ড দেখে ফিসফাস শুরু হয়ে যায় গ্রামজুড়ে। প্রতিবেশীরা বলতে থাকেন, ‘ও পাগল হয়ে গেছে। ধরা খাবে, লোকসানে পড়বে, আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই জমিতে আর কিছুই হবে না।’
কিন্তু গ্রামবাসীর এসব কথা গায়ে মাখেননি আমিরুল। তিনি কাজ করতে থাকেন আপনমনে। প্রথমে মাল্টার গাছ রোপন করেছিলেন। এরপরে মাল্টাবাগানে ১১ মিশ্রফসল ফলিয়ে বাজারজাত করে ভাল আয় করেন এবং মাল্টা গাছ থেকেও ভাল আয়ের সম্ভাবনা দেখছেন। এই মিশ্র বাগানে ১১ সাথি ফসল করে ইতোমধ্যেই এলাকায় চমক লাগিয়ে দিয়েছেন আমিরুল ইসলাম।
এখন তাঁর বাগানে মাল্টার ফলন আসতে শুরু করেছে। শুধু কি মাল্টা ? একই মিশ্র বাগানে ১১ ধরনের সাথি ফসল ফলিয়ে উপজেলা জুড়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন এই মাল্টাচাষি।
আমিরুল ইসলামের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার হোসেনগাঁও ইউনিয়নের ক্ষুদ্র বাঁশবাড়ী গ্রামে। তাঁর মাল্টাবাগানটাও সেখানে। সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, ওই গ্রামের প্রবেশপথেই স্থানীয় পাকা সড়কঘেঁষা মাল্টাবাগানে গমের চাষাবাদও হচ্ছে।
সড়ক থেকে নেমেই এরপর খেতের ভেতরে যেতেই চোখে পড়ে গমের পাশাপাশি আলাদা করে আলুর চাষ। আর একটু এগোতেই দেখা যায়, লাউয়ের মাচা। তার পাশেই পটোল ও শিমের চাষাবাদ। আরও একটু সামনে এগোতেই মসলাজাতীয় ফসল পেঁয়াজ, রসুন ও হলুদের আবাদ। এ ছাড়া কাঁচা মরিচ, পুঁইশাক, লাপাশাক ও লেবুর আবাদও করা হচ্ছে ওই বাগানে।
মাল্টা বাগানেই কথা হয় বাগানমালিক আমিরুলের সঙ্গে। প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘শুরুটা ছিল তিন বছর আগে। রাণীশংকৈল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জয় দেবনাথের আগ্রহে এবং তাঁর সার্বিক সহযোগিতায় এক একর আবাদি জমিজুড়ে ২৮৪টি মাল্টার গাছ রোপণ করি। এরপর শুরু হয় পরিচর্যা। গাছের বয়স এক বছর হলে দেখি প্রতিটি মাল্টা গাছ থেকে আরেক গাছের মাঝখানে প্রায় ১০ বর্গফুট জায়গা ফাঁকা থাকছে। পরে চিন্তা করি, ছোট হাল দিয়ে চাষ দিলে এখানে আবাদ করা যাবে। প্রথমে আবাদ করলাম বোরো ও আমন ধান, পরের বছর আলু।
এবছরে বোরো-আমনের পর জমিটাকে বিভিন্নভাবে ভাগ করলাম। প্রথম ভাগে রোপণ করলাম গম, দ্বিতীয় ভাগে আলু এবং তৃতীয় ভাগে লাউ, শিম, হলুদসহ বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ও মসলাজাতীয় ফসল। মাল্টা চাষ করলেই যে অন্য ফসল অচাষযোগ্য, তা কিন্তু নয়। আপনি চেষ্টা করলেই পারবেন। এতে আপনার মাল্টাগাছেরই উপকার বেশি হবে। অন্যান্য ফসলে দেওয়া সারগুলো মাল্টাগাছও পাবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, মাল্টাগাছের শিকড় যেন কাটা না যায়।’
আমিরুল ইসলামের এমন ব্যতিক্রমী আবাদ দেখে অবাক এলাকার সাধারণ মানুষসহ অন্য কৃষকেরা। গ্রামের দোকানগুলোয়ও আলোচনা হচ্ছে তাঁর এই ব্যতিক্রমী আবাদ নিয়ে।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলার হোসেনগাঁও ইউনিয়নের ক্ষুদ্র বাঁশবাড়ী গ্রামে কৃষক আমিরুল মাল্টা চাষের পাশাপাশি অন্য ১১সাথি ফসল চাষ করছেন। এটি উপজেলার একেবারেই নতুন ও প্রথম । আমরা সেখানে মাল্টা চারা সরবরাহ করেছি। সেইসাথে কৃষি অফিস থেকে তাদের বাগানে প্রযুক্তিগত সকল সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে। বাগান থেকে প্রথম বছরই তিনি লক্ষাধিক টাকার মাল্টা বিক্রয় করতে পারবে এমনটা আশা করা যায়।
এবিষয়ে কথা হয় ওই এলাকার বাসিন্দা সুমন, কবিরসহ অন্তত ১০ জনের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, ‘আমিরুল ইসলাম ডিগ্রি পাস করা শিক্ষিত ছেলে। সে যে এভাবে এ এলাকার নতুন ফসল মাল্টাবাগান করতে পারবে এবং পাশাপাশি মাল্টাবাগানের মধ্যেই আবার বুদ্ধি করে এতগুলো ফসল ফলাতে পারবে, তা আমাদের বিশ্বাস হয়নি প্রথমে। সরেজমিন দেখে আমরা অবাক হয়েছি। আসলে চেষ্টা করলে সবই সম্ভব।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জয় দেবনাথ বলেন, ‘সমগ্র উপজেলা মিলিয়ে মোট ১৬ হেক্টর জমিতে ৩০০ জন মাল্টাচাষি রয়েছেন। এঁদের মধ্যে ক্ষুদ্র বাঁশবাড়ী গ্রামের আমিরুল ইসলাম মাল্টার বাগানেই গম, আলুসহ বিভিন্ন শাকসবজি চাষ করছেন। এতে আমরাও অবাক হয়েছি, তাঁর চেষ্টা দেখে।’ তিনি আরও বলেন, মাল্টাগাছের শিকড়ের দিকে খেয়াল রেখে মাল্টাবাগানে যে অন্য ফসলের আবাদ করা যাবে, তার বড় উদাহরণ এটি।
Post Views: 220