জুলফিকার বকুল
সহকারি শিক্ষক,ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি স্কুল, গাজীপুর।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ১৪ ডিসেম্বর একটি মর্মান্তিক আত্মবেদনায় হৃদয়ে রক্তক্ষরণের এক চরম নিদারুণ কষ্টদায়ক দিন। যে দিন বাঙালি অন্তরাত্মায় জমাট বাঁধা রক্তের প্রতিটি ফোঁটা তীব্র যন্ত্রনার অনুভূতি সৃষ্টির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত করে। জাগ্রত করে সূর্য সন্তানদের প্রতিভা হত্যার জঘন্যতম নির্মম, নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক প্রতিবাদী সত্তাকে। বাঙালি সত্তা আজও ঘৃণার কার্তুজ ছোড়ে সেই নরপিশাচদের বিরুদ্ধে। আর এ বারুদ কখনও নিভে যাবেনা কুয়াশার চাদরে। চলবে অবিরত- অবিরাম তেজদীপ্ত শিখা হয়ে।
পাকিস্তানি হায়েনাদের বর্বরোচিত গণহত্যায় অকাতরে বুক পেতে দিয়েছে বাংলার মুক্তিকামী বীর সেনারা। বাংলা মায়ের সম্মান সমুন্নত রাখতে যাদের বুক এতটুকু কাঁপেনি তাঁদের রক্তে ভেজা লাল সবুজের পতাকা বিশ্ব মানচিত্রে আজ সগৌরবে উড়ছে। আমরা বিজয় অর্জন করেছি। ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বিজয় বাঙালি চেতনাকে যেমন সুগঠিত করেছে তেমনি বুদ্ধিজীবি আলোকিত প্রেরণা দেশ গঠনের প্রত্যয়কে সুদৃঢ় করেছে। আজ আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই আত্মত্যাগ ও অবিস্মরণীয় অবদানকে ধারণ ও লালন করে নতুন-তরুণ প্রজন্মকে বুদ্ধিদীপ্ত সাহসী পরিকল্পনায় দেশের তরে কাজ করে যাওয়া শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, বিপ্লবকে জাগ্রত রাখাও বটে।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবি দিবসের সংকলন,পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘ নিউজ উইক ‘এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায় যে,বুদ্ধিজীবির সংখ্যা মোট এক হাজার সত্তর জন। যদিও মাত্র তিনশত বুদ্ধিজীবির কথা আমরা জানতে পেরেছি।যার মধ্যে ছিল অধ্যাপক,ডাক্তার,কবি,সাহিত্যিক,গবেষক,চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ আরো নানা পেশার প্রতিভাবান সৃজনশীল ব্যক্তিরা।কিন্তু আমি মনে করি ত্রিশ লক্ষ শহীদের মধ্যে আরো কত যে মেধাবী প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি ছিল তার হিসাব হয়ত কারো জানা নেই।
সামগ্রিকভাবে দেশকে মেধাশূণ্য করতে সারা দেশেই ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই হত্যাযজ্ঞ অভিযান চালিয়ে ছিল মানবতাহীন আগ্রাসী দানবেরা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের গণতন্ত্র মনস্ক বুদ্ধিজীবিদের বাছাই করে হত্যা করেছে। আর এ পৈশাচিক কাজে সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া ভীরু, কাপুরুষের দল রাজাকার,আলবদরেরা। যারা পাকিস্তানিদের গোলাম হয়ে আপন ভাইয়ের বুকে গুলি চালিয়েছে। যে নির্মমতার চিত্র আজও শোকাহত পরিবারের আপনজনের স্মৃতিপটে বাস্তবতায় রুপ নেয় প্রতিটি ক্ষণে। এটা কাল্পনিক কোন রুপকথার গল্প নয়। চরম সত্য আত্মদানে রক্তস্নাত আঁচলের প্রতিটি সুতায় গাঁথা বীরের কাহিনি। যা কখনও হারিয়ে যাবেনা শত বিপ্লবের রক্তক্ষয়ী সমরাঙ্গনে।
দেশপ্রেম মানুষকে কতটা ত্যাগী ও বিপ্লবী করে তোলে তার প্রমান বিশ্ববাসী বাঙালী জাতিসত্তায় সংগ্রামী জনতার মাঝে অবলোকন করেছে।৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের প্রতিটি জাতি – গোষ্ঠীর বুকে দেশপ্রেমের অবিনাশী চেতনা জাগ্রত করেছে। তাই বাঙালি হিসেবে আমরা গর্বিত। এই গৌরব সমুজ্জ্বল রাখতে বুদ্ধিজীবি ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুধু মুখস্থ রাখলেই দায়িত্ব শেষ হবেনা,শত বাধাকে অতিক্রম করে বিশ্ব নেতৃত্বে আমাদের বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যুগোপযোগী অবদান রাখতে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন। যুগে যুগে তরুণরাই নতুনত্বের আবির্ভাব ঘটিয়ে ইতিবাচক পরিবর্তনে নিজেকে আত্ম নিয়োগ করেছে। সময় এখন মেধা দিয়ে শিক্ষা,সংস্কৃতিতে দেশকে সমৃদ্ধ করা। মনে রাখা প্রয়োজন,সেই ভয়ার্ত দিনগুলোতে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের দেহের অবসান হলেও আত্মার মৃত্যু হয়নি। ওরা বাংলার ঐক্যবদ্ধ মুক্তি পাগল জনতার সাহসী দেশপ্রেমের কাছে পরাজিত নিশ্চিত জেনেই দুর্বল কু-চিত্তের প্রলোভনে মেধা ধ্বংসের লীলায় মত্ত হয়েছিল। ওরা ভেবেছিল, একটি গাছকে তার মূল থেকে কেটে দিলেই প্রজাতি ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু ওরা জানেনা যে, প্রতিটি বীজ থেকেই প্রকৃতি এক একটা বড় বৃক্ষের জন্ম দিতে পারে। কাজেই, প্রতিটি জাতীয় দিবসই আমাদের অনুপ্রেরণার বাতিঘর।
দিবসের তাৎপর্যকে অনুধাবন করে ব্যক্তি জীবন গঠন মানেই দেশের মানব সম্পদে নিজেকে পরিনত করা। যারা আপনজন হারানোর কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে বেঁচে আছে তারা আমাদেরই দেশ মাতার ব্যথিত সন্তান। তাদের চোখের পানিকে মুছে দিতে উন্নত দেশ গঠনে শপথ নিতে হবে। শোক কে শক্তিতে পরিনত করে স্বপ্ন জয়ের লক্ষ্যে পৌছানোই হোক আমাদের একমাত্র প্রত্যয়।