কৃষকদের অভিযোগ,তাঁদের কাছ থেকে সারের দাম বেশি নেওয়া হলেও ডিলাররা কোনো রসিদ দিচ্ছেন না। কেউ কেউ রসিদ দিলেও তাতে সরকার নির্ধারিত দাম দেখাচ্ছেন। প্রতিবাদ করলে সার বিক্রি করবেন না জানিয়ে দিচ্ছেন বা ক্রেতার কাছে বিক্রি করা সার কেড়ে নিয়ে রেখে দিচ্ছেন। ডিলারদের কাছে এভাবে জিম্মি হয়ে তাঁরা অসহায় বোধ করছেন। তবে এ বিষয়ে ডিলারদের দাবি, চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম পাওয়ার কারণে বাজারে সারের কিছুটা সংকট তৈরি হয়েছে। তবে সরকার নির্ধারিত দামেই সার বিক্রি করছেন তাঁরা।
কৃষকেরা বলছেন, সার কিনতে গেলে ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা সংকটের কথা বলেন। তবে দাম বেশি দিলেই সার বের করে দিচ্ছেন। এ ছাড়া কিছু কিছু ডিলার দোকানে মূল্যতালিকা টাঙিয়ে রাখলেও সেই অনুযায়ী বিক্রি করছেন না। এমনকি সরকারি দরের রসিদ দিলেও বাড়তি দরের রসিদ দিচ্ছেন না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাণীশংকৈল কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার প্রতি বস্তা (৫০ কেজির বস্তা) টিএসপি সারের খুচরা মূল্য ১ হাজার ১০০ টাকা (২২ টাকা প্রতি কেজি), এমওপি প্রতি বস্তা ৭৫০ টাকা (১৫ টাকা কেজি), ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) ও ইউরিয়া প্রতি বস্তা ৮০০ টাকা (১৬ টাকা কেজি) নির্ধারণ করে দিয়েছে।
ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, চলতি ডিসেম্বর মাসে জেলায় ২ হাজার ৫৫৩ মেট্রিক টন টিএসপি, ৩ হাজার ১৭৫ মেট্রিক টন এমওপি, ৭ হাজার ৭৩ মেট্রিক টন ডিএপি এবং ৭ হাজার ২৯৫ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জেলার ডিলারদের ৩০২ মেট্রিক টন টিএসপি, ৫৩৬ মেট্রিক টন এমওপি, ১ হাজার ৮৮৬ মেট্রিক টন ডিএপি এবং ১ হাজার ২১২ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার সরবরাহ করা হয়েছে।
এসব সার বিসিআইসির ৬৩ এবং বিএডিসির ১৪০ জন ডিলারের মাধ্যমে জেলার কৃষকদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। বুধবার পর্যন্ত ৯৮ মেট্রিক টন টিএসপি, ৩৮৬ মেট্রিক টন এমওপি এবং ৩১২ মেট্রিক টন ডিএপি উত্তোলন করেছেন ডিলাররা।
রবি মৌসুমে জেলায় আলু, ভুট্টা, ধান, শর্ষেসহ ব্যাপক সবজির উৎপাদন হয়। এসব ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে জমিতে কৃষকেরা টিএসপি, এমওপি, ডিএপি ও ইউরিয়া সার ব্যবহার করেন।
রাণীশংকৈল উপজেলার ভরনিয়া এলাকার কৃষক মুন্জর হোসেন (৪৫) বলেন, তিনি মঙ্গলবার নেকমরদ বাজারে এক ডিলারের দোকানে এক বস্তা টিএসপি ও এক বস্তা পটাশ কিনতে যান। প্রথমে ডিলার তাঁকে টিএসপি সার নেই বলে জানিয়ে দেন। পরে বিভিন্ন মাধ্যমে কথা বলার পর ডিলার তাঁকে দুই বস্তা সার বের করে দেন। প্রতি বস্তা টিএসপি ১ হাজার ৬০০ টাকা এবং এমওপি ১ হাজার ১০০ টাকায় দেন।
মুন্জর হোসেন বলেন, সরকারি দামে প্রতি কেজি টিএসপি ২২ টাকায় বিক্রি করার কথা; দোকানদার তা বিক্রি করছেন ৩২ টাকা। বস্তাপ্রতি টিএসপি সার ৫০০ টাকা এবং এমওপি ৩৫০ টাকা বেশি দামে কিনতে হয়েছে। রসিদ চাইলেও তাঁরা বাড়তি দামের রসিদ দেননি।
উপজেলার রাতোর গ্রামের কৃষক আজিজুর রহমান বলেন, কয়েক দিন আগে একজন খুচরা সার বিক্রেতার কাছ থেকে প্রতি বস্তা টিএসপি সার দেড় হাজার টাকায় কিনেছেন। রসিদ চাওয়ায় দোকানদার তাঁর সারের বস্তা কেড়ে নিচ্ছিলেন।
বাড়তি দরে সার বিক্রির অভিযোগ পেয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. শেখ সাদী জেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালান। সে সময় তিনি সরকারি নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রির সত্যতা পান। তিনি সদর উপজেলার আরিফ ট্রেডার্স ও পীরগঞ্জের হাবিবুর রহমান ট্রেডার্সকে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেন।
এদিকে আজ বুধবার সকালে অভিযান চালিয়ে শহরের নিউ ঐশি বীজ ভান্ডারের মালিক এনামুল হককে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু তাহের মো. সামসুজ্জামান।
এর আগে গত সোমবার বাড়তি দামে সার বিক্রি, কৃষককে রসিদ না দেওয়ার অভিযোগে রানীশংকৈলের রাউতনগর বাজারের হাসান ট্রেডার্সের মালিক হাসান আলীকে ৫ হাজার টাকা, নেকমরদ বাজারের মেসার্স আল ইমরান ট্রেডার্সের মালিক খায়রুল আলমকে ১০ হাজার টাকাসহ দুই ব্যবসায়ীকে মোট ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন রানীশংকৈলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইন্দ্রজিৎ সাহা।
রানীশংকৈল উপজেলার কাতিহার হাট এলাকার সার ব্যবসায়ী আনছার আলী বলেন, অন্য জায়গা থেকে বেশি দামে সার কিনে এনে এখানে বিক্রি করতে হচ্ছে। তাই একটু বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আবু হোসেন বলেন, এখন সারের কোনো ঘাটতি নেই। এরপরও কোথাও কোথাও সংকটের অজুহাতে বেশি দামে সার বিক্রি করার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সরকার নির্ধারিত মূল্যে সার বিক্রির জন্য তাঁদের তদারকি অব্যাহত রয়েছে।
এ বিষয়ে বিসিআইসির ডিলারদের সংগঠন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) সাধারণ সম্পাদক মো. শামসুজ্জামান বলেন, তাঁদের সমিতির সদস্যরা সরকার নির্ধারিত দামের বাড়তি দামে সার বিক্রি করছেন না। অনেক জায়গায় অনুমোদনহীন কিছু ব্যবসায়ী জেলার বাইরে থেকে সার সংগ্রহ করে বেশি দামে বিক্রি করে থাকতে পারেন। এর দায় তাঁরা নেবেন না।
ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, সার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সরকার নির্ধারিত দামের বেশি দামে সার বিক্রির অভিযোগ আসছে। যেখানেই অভিযোগ পাচ্ছি, সেখানেই অভিযান চলছে।