শিক্ষক, ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি স্কুল, গাজীপুর।
—————————————————-
আদিম কালের মানুষ গাছের ছাল,পাতা পড়ে লজ্জা নিবারণ করত।পাহাড়ের গুহায়,গাছের ডালে মাচা বেঁধে ঘুমাত।আস্তে আস্তে মানুষের জ্ঞানের বিকাশ ঘটতে লাগল,নতুন নতুন পরিকল্পনার চিন্তা করা শুরু করল।মানুষ সভ্য জাতিতে পরিণত হলো।সভ্যতা পরিবর্তিত হতে হতে আধুনিকতায় এসে দাঁড়ালো।আমরা এখন আধুনিক সভ্যতার মানুষ। জ্ঞান বিকাশের উচ্চ স্তরে এখন আমাদের বসবাস।তাই বিজ্ঞান-প্রযুক্তির নতুনত্বের ছোঁয়ায় প্রায় সারা বিশ্বেই গড়ে উঠেছে আরামপ্রদ জীবন ব্যবস্থা।
বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয় বন্দী। খুব সহজেই বিশ্বায়নের যুগে নানা তথ্যের অনুসন্ধান করা এখন সাধারণ একটি ব্যাপার।একটি দেশ,জাতি,সংস্কৃতির তথ্য থেকে সহজেই অনুমেয় হয় যে দেশটি কতটা উন্নত। তথ্য-প্রযুক্তির আশীর্বাদে এমন বিস্তারিত জানাটা সম্ভব হয়েছে।আজ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর ইতিহাস থেকে অনায়াসেই জানা যায় তাদের উন্নতির ইতিহাস। নতুন নতুন ভাবনাকে কাজে লাগিয়েই যুগোপযোগী পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা নিজেদের গড়েছে নতুনরুপে।কাজেই নতুনের সৃষ্টি কখনও থেমে থাকে না।যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহমান থাকে।শুধু প্রয়োজন সৃষ্টিশীল মানসিকতা। একটি পরিবারের একজন অভিভাবক যদি হয় বিচক্ষণ, সৃজনশীল ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, তাহলে সেই পরিবারের সদস্যরা শিক্ষা, সংস্কৃতি, নৈতিকতায় রুচিশীল হয়ে বড় হতে থাকে।একসময় পরিবারটি হয়ে উঠে সামাজিকভাবে উন্নত।
এভাবে পরিবার,সমাজ উন্নয়নের মধ্য দিয়েই জাতি তথা দেশ উন্নত হয়।পরিবারের অভিভাবকদের রয়েছে গুরুদায়িত্ব। যে দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালনের মধ্য দিয়ে পরিবারটিকে সুসংগঠিত ও উন্নয়নমূখী করা যেমন কর্তব্য পালন হয় তেমনি স্ব স্ব পরিবারের মধ্যে হলেও মৃত্যুর পরে অমরত্ব লাভ করা যায়।যে পরিবারে নিবিড় পরিচর্যায় সন্তানের ভবিষ্যতকে উপলব্ধি করা হয়েছে,সেই পরিবারেই কাঙ্খিত মেধাবী সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে।পরিবারটি এলাকার মধ্যে স্বনামধন্য হিসেবে পরিচিত হয়েছে।নতুন প্রজন্ম সেই ঐতিহ্য,সুনামকে অক্ষুণ্ণ রাখতে ধারাবাহিকতা বজায় রাখছে। অপরদিকে, পুরোনো সিস্টেমকে ফলো করে গতানুগতিক ভাবে যে পরিবারটি পরিচালিত হচ্ছে তারা পুরোনো সীমাবদ্ধতার বেষ্টনীতে আটকে পড়েছে।পুরোনো থেকে শিক্ষা,পদ্ধতি নেয়া যেতে পারে কিন্তু তার মধ্যে আটকে থেকে নতুনত্বকে অনুসন্ধান না করা মানেই দায়িত্বে অবহেলার সহিত ভীরুতা প্রদর্শন করা।যুগে যুগে ইতিবাচক পরিবর্তনে বাঁধা এসেছে একথা সত্য, তাই বলে আবিস্কার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়নি তা কিন্তু নয়।একটি পরিবারে যাঁরা নীতিনির্ধারকে দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁদের মধ্যে অনেকের সাহসী ভূমিকা তাঁকে অমর করে রেখেছে।আজও মানুষ তাঁদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
সতীদাহপ্রথা ছিল হিন্দু ধর্মের কুসংস্কারাচ্ছন্ন নিষ্ঠুরতম এক বর্বরোচিত ইতিহাস। বিভিন্ন সময়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জেগে উঠলেও এই কুসংস্কারকে সমাজ থেকে উচ্ছেদ করা যাচ্ছিল না।অবশেষে, নিজ দেশের সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ( ১৮২৮ — ১৮৩৩) রেগুলেশন XVII, ১৮২৯ পাস করেন। বেন্টিঙ্ক নিজেও একজন মানবহিতৈষী সংস্কারপন্থী ছিলেন। এই আইনে ‘সতীদাহ প্রথা বা হিন্দু বিধবা নারীকে জীবন্ত দাহ বা সমাধিস্থ করা বেআইনি’ বলে ঘোষণা করা হয়। শিক্ষার প্রসার, খৃষ্টান মিশনারীদের প্রচার, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ও হিন্দু সংস্কারবাদী আন্দোলনের ফলেই সতীদাহ প্রথা সমূলে বিলুপ্ত করা সম্ভব হয়েছিল।আর এই পদক্ষেপ গ্রহন করতে রাজা রাম মোহন রায়কে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পোহাতে হয়েছে। সে সময়ের হিন্দু কুসংস্কারপন্থীরা সহজে তা মেনে নিতে চায়নি।আজকের বিশ্বের সভ্য সমাজের প্রতিটি মানুষের কাছেই বিষয়টি অমানবিক। অথচ তখন মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে ছিল বিষয়টি অমানবিক।এটাই দর্শন।কারো কাছে যেটা সত্য, অন্যের কাছে তা মিথ্যে হয়ে দেখা দেয়।এই দার্শনিক গবেষণা থেকেই সৃষ্টি হয় নতুনত্ব। লিওনার্দো দ্য ভেঞ্চি মোনালিসাকে এঁকেছিলেন কল্পলোকের চোখ দিয়ে।যে মোনালিসার প্রতিরুপের সন্ধান এখনো মেলেনি।ভেঞ্চির অন্তরালের দৃষ্টিতে কি এমন নতুনত্বের ছোঁয়া ছিল যে, ছবিটিকে ঘিরে রয়েছে নানা রহস্য।১৬ এর শতকে যদি ভেঞ্চির চেতনায় এমন দূরদর্শিতা জাগ্রত হয়,তবে একবিংশ শতাব্দীতে কেন নয়? দৃষ্টি যত গভীর হয় ভাবনা তত প্রগাঢ় হয়, ততই সমাধানের পথও সুগম হয়।
সাহস যতটা প্রখর হয় সত্য ততটাই প্রতিষ্ঠিত হয়।সততার সাহস মানুষকে আত্মপ্রত্যয়ী সংগঠক করে তোলে,সৃজনশীলতার দর্শন পরিপূর্ণতার তৃপ্তি আনে।মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেহের অবসান হলেও আত্মার মৃত্যু হয় না।আর মানব কল্যাণে আত্মনিয়োগের মাধ্যমেই আত্মার প্রশান্তি হয়। কারণ,একমাত্র মানুষের মাঝেই মানুষ বেঁচে থাকে অনন্তকাল ধরে। ত্যাগী,গুণীজনরা কখনও মরে না।তাঁরা সমাজ সংস্কার তথা মানব কল্যাণে যুগে যুগে আসে।
আমরা দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জন করেছি। এ বিজয় আমাদের স্বাধীনচেতা করেছে। আমরা দেশপ্রেম বুকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়তে চাই।কিন্তু মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া।এজন্য আত্ম পরিশুদ্ধতা একান্ত প্রয়োজন। নিজেকে যোগ্য করে তোলার মধ্য দিয়েই পরিবারও যোগ্য ও মর্যাদাপূর্ণ হয়ে উঠে। একটা ভাল কাজের পরিকল্পনাই উদ্ভাবনের দ্বার উন্মোচন করে।ইংল্যান্ড পরিকল্পনার মাধ্যমে শিল্প বিপ্লব ঘটিয়ে খুব দ্রুত কৃষিপ্রধান দেশ থেকে শিল্পপ্রধান দেশে রুপান্তরিত হয়েছিল।তাঁরা নিজেকে যোগ্য ও কার্যকর করতে পেরেছিল বলেই আজ এতটা উন্নত। সময় এসেছে আমাদেরও ঘুরে দাঁড়ানোর। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ।এই এগিয়ে নেয়ার কাজে যারা নিয়োজিত আছেন,তাঁদের আরো দৃঢ় মনোবল নিয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার প্রত্যাশায় অগ্রণী ভূমিকা রাখাটা মহত্ত্বের পরিচয় বহন করে।
দেশ প্রেমের ব্রত নিয়ে অদম্য দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাক নতুনের পথচলায়।পরিবার উন্নয়নের মধ্য দিয়ে গ্রামগুলো হয়ে উঠুক শহরমুখী।প্রতিটি অভিভাবক পরিবারের কাছে অম্লান,অমরত্ব লাভ করুক।জয় হোক মানবতার।