জুলফিকার বকুল
শিক্ষক, ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি স্কুল, গাজীপুর।
—————————————————–
শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয় তবে শিক্ষক হয় সেই মেরুদণ্ডের ভীত দৃঢ় করণের কারিগর। কেননা একজন আদর্শ শিক্ষকই পারেন তার অনুসারী দের জ্ঞান ও ন্যায় দীক্ষা দিতে। শিক্ষার্থীর মানবতাবোধ কে জাগ্রত করে একজন শিক্ষক কেবল পাঠদানকে সার্থকই করে তোলেন না, পাশাপাশি সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে দক্ষ জনশক্তির মাধ্যমে দেশের উন্নয়নকে ত্বরাণ্বিত করেন। স্বীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করে তাদেরকে দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলেন।
সর্বোপরি, একজন প্রকৃত মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরীতে শিক্ষকের ভুমিকা অনস্বীকার্য। কাজেই এ মহান দায়িত্ব পালনে একজন শিক্ষকের যেমন জ্ঞান, দক্ষতা ও আন্তরিকতা প্রয়োজন তেমনি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও সহিষ্ণুতাও একান্ত জরুরি। কারণ, বাবা-মা সন্তানকে মানুষ হিসেবে জন্ম দিলেও তাকে মানবিক গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে মানুষ হতে হয়।আর এ কাজটি যথাযথ ও সুনিয়ন্ত্রিতভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যেই শিক্ষকের দ্বারস্ত হতে হয়। তাই মানুষ তৈরীতে শিক্ষকের গুরুদায়িত্বের পাশাপাশি দায়বদ্ধতাও রয়েছে।
এই দায়বদ্ধতার ব্রত নিয়ে যাঁরা শিক্ষা এবং দীক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরাই মৃত্যুর পরও শিক্ষার্থীর মাঝে স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে আছেন।যাঁরা অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তানরুপে সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলেন তাঁদের মর্যাদা চির অম্লান হয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাঝে বয়ে চলে অবিরাম।
শিক্ষকতা একটি মহৎ পেশা। তাই এ পেশায় প্রবেশের পূর্বে নিজেকে যোগ্য ও মানবিক গুণাবলী দ্বারা পরিপূর্ণতা অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন।কারণ, এই মহত্ত্বের পরিচয় বহন করা তাঁর কাছে একটি চ্যালেঞ্জ। শিক্ষকের অনুপ্রেরণা যেমন শিক্ষার্থীকে মানুষরুপে গড়ে তোলে তেমনি প্ররোচনা, নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষার্থীকে বিপদগামী করে তোলে,এমনকি কখনও কখনও তা আত্মঘাতী করে তোলে।
সঠিক শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন বা শাস্তি কখনও শিক্ষা অর্জনের সম্পূরক ভূমিকা রাখে না।তরুণ মনে শাস্তি সবসময়ই বিরুপ প্রভাব ফেলে।
এমনও দেখা গেছে যে,শিক্ষকের শাস্তির ভয়ে শিক্ষা অর্জন থেকে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে।অবশেষে, সামাজিক নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে।শারীরিক বা মানসিক শাস্তি কখনও ফলপ্রসু শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে সফলতা বয়ে আনে না।তাই যেসব শিক্ষক মনে করেন যে,শিক্ষাদান করতে শাস্তির প্রয়োজন আছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তা অতিমাত্রায় প্রয়োগ করা প্রয়োজন, কেবল সেই মানসিকতার শিক্ষক দ্বারাই শিক্ষক সমাজ কলুষিত ও মর্যাদাহীন হয়ে পড়ছে।
সাম্প্রতিক সামাজিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু কিছু ভিডিও চিত্র থেকে দেখা গেছে যে,শিক্ষার্থীকে শাস্তি দেওয়ার কৌশল মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়।মনে প্রশ্ন জাগে আদৌও এরা শিক্ষক কি না। এভাবে শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে তারা আসলে কি শিক্ষা দিতে চায়।আনুগত্য, দাসত্ব না পশুত্ব। নিজের রাগ,ক্রোধকে সংযত রাখতে না পারা মানেই অনিয়ন্ত্রিত আত্মশক্তির কাছে পরাজিত হওয়া।যেখানে একজন শিক্ষক নিজে যেমন আত্মশক্তি অর্জন করবেন তেমনি শিক্ষার্থীর মাঝে তা সুচারুরুপে প্রখর করে তুলবেন, অথচ সে নিজেই যখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা তখন তার কাছে শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার প্রশ্ন জাগে।
দুনিয়াতে বহু অনিষ্টের কারণ হলো রাগ বা ক্রোধ। মানুষ এ রাগের বশবতী হয়ে অনেক নির্দয় ও অত্যাচারমূলক কাজ করে ফেলে। এ রাগের ফলে মানুষ সম্মানিত হওয়ার পরিবর্তে লজ্জা ও অবজ্ঞার শিকার হয়। তাই কারো দ্বারা কোনো ক্ষতি বা অন্যায়মূলক কাজ হয়ে গেলেও রাগ না করে ক্ষমা করা বা ধৈর্য্য ধারণ করা মহত্ত্বের কাজ। কারণ রাগ নয় ক্ষমায় রয়েছে মুমিনের সাফল্য।আর শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে তো তা একেবারেই সহনশীলতা ও বিচক্ষণতার আলোকে সমাধা করা উচিৎ। ভুল সংশোধন করে সঠিক শিক্ষা দেওয়াই শিক্ষকের প্রধান দায়িত্ব। জোর করে, চাপিয়ে দিয়ে প্রভূত্ব অর্জনের প্লাটফর্ম শিক্ষকতা নয়।শিক্ষককে হতে হবে যে কোন পরিস্থিতিতে ইতিবাচক।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, ‘ একজন শিক্ষক তাঁর বাস্তব ও কাল্পনিক চিন্তার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে শিক্ষার্থীদের ভিতরের ঘুমন্ত চিন্তাশক্তিকে বের করে আনবেন। ফলে শিক্ষার্থী গবেষণানির্ভর শিক্ষাদানের মাধ্যমে নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ পাবে।’
কাজেই কাজটি অত্যন্ত যত্মশীল ও মহানুভবতার সহিত করা বাঞ্ছনীয়। আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তির যুগে বাস করে প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় কৌশলে শিক্ষাদান করা বর্তমান সময়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে অনুকূল পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে অনেক প্রশিক্ষণ আছে।
বিভিন্ন বই,ভিডিও,গাইড ইত্যাদিও এখন বিশ্বায়নের যুগে হাতের নাগালেই পাওয়া যায়। তাই শিক্ষক হিসেবে নিজের পেশাগত দক্ষতা ও মর্যাদা অর্জনের জন্য স্ব-উদ্যোগে এসব অনুসন্ধান করে জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি প্রশিক্ষিত হওয়া একান্ত জরুরি। অন্যথায়, শিক্ষক কখনও কেউ হয়ে আসেনা,শিক্ষক হতে হয়।ব্যক্তি বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হলেও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখা উচিৎ আমি একজন শিক্ষক।আমি শিক্ষার্থীর কাছে একজন আদর্শ ব্যক্তি। আমি শিক্ষার্থীকে পরিপূর্ণ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তার মাঝে বেঁচে থাকবো।
শিক্ষকের সাথে শিক্ষার্থীর পারস্পরিক সম্পর্ক হবে বন্ধুত্বপূর্ণ। যে বন্ধুত্বের মাঝে স্নেহ, মায়া,মমতা,ভালবাসা,শ্রদ্ধা ইত্যাদি দৃঢ় থেকে সুদৃঢ় হবে। যেমনটি একটি শিক্ষার্থী তার নিজ পরিবারে বাবা-মা এর কাছ থেকে পায়।
আমরা গৌরবময় জাতি হিসেবে শিক্ষা, সংস্কৃতি তথা সার্বিক উন্নয়নে বিশ্ব দরবারে এগিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীর মাঝে দেশপ্রেম তৈরী করে তাকে আগামি নেতৃত্বের যোগ্য ও মানবিক মূল্যবোধের মানুষ করে গড়ে তোলা গুরুদায়িত্ব। ব্যক্তি আক্রোশ বা ক্ষীণ মানসিকতার পরিচয় দিয়ে শিক্ষা, শিক্ষক তথা দেশ ও জাতিকে কলংকিত করা একজন শিক্ষকের কাছ থেকে কখনই কাম্য নয়।
তাই, আমাদের আরো ধৈর্য্য, সহনশীল, বিচক্ষণতা ও আন্তরিকতার সহিত শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া প্রয়োজন। দুর্নীতিমুক্ত দেশগঠনে শিক্ষক প্রগতি ও সৃজনশীল শিক্ষাদানে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে এমনটি জাতি প্রত্যাশা করে।
মানসম্মত শিক্ষায় এগিয়ে যাক দেশ।শক্ত মেরুদণ্ডের উপর উজ্জ্বল গৌরবে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাক লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত লাল সবুজের পতাকা।