যমুনা, করতোয়া, হুরাসাগর, বড়ালসহ ছোটো -বড় বিভিন্ন নদী বেষ্টিত শাহজাদপুর। সেই সাথে বিল-ঝিল, হাওরে সমৃদ্ধ এই জনপদ। দেশের অন্যতম বৃহত্তম চলনবিলের কিছুটা অংশও রয়েছে শাহজাদপুরে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই এটি নিম্নাঞ্চল হিসেবেই পরিচিত। আবহমান বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্যের আদর্শ রূপ এই অঞ্চল। শাহজাদপুরের মূল শহরের চারিপাশে অগুনিত নক্ষত্রের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রামগুলো আবহমান বাংলাকেই উপস্থাপন করে। ৬ লক্ষাধিক মানুষের এই জনপদে একসময় নৌপথ ছিল প্রধান যোগাযোগ ব্যাবস্থা। কালের বিবর্তে তার এখন পরিবর্তন এসেছে।
এখন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও পৌঁছে গেছে পাকা সড়ক। বিশেষ করে গত এক দশকে গ্রাম অঞ্চলের মানুষের জীবনমান পরিবর্তন করতে যোগাযোগ ব্যাবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন লক্ষ্য করার মতই। মাঠের পর মাঠ পেড়িয়ে সিঁথির মত যে মেঠোপথ বয়ে চলতো এক টুকরো গ্রামের দিকে সেই রাস্তাও এখন কংক্রিটের রাস্তায় পরিবর্তন হয়েছে। একসময় ঘোড়া, গরু বা মহিষের গাড়ি ছাড়া যে সমস্ত রাস্তায় চলাচল করতে কষ্ট হতো সে সমস্ত জায়গায় সশব্দে ছুটে চলে বিশাল বিশাল ট্রাক,বাস, লেগুনা, সিএনজি। এর ফলে শহরের সাথে যেমন মানুষের দূরত্ব ঘুচেছে তেমনি বেড়েছে কর্মসংস্থান। এছাড়াও শাহজাদপুরের তাঁতশিল্প ও দুগ্ধশিল্পের জন্য রয়েছে বিশেষ খ্যাতি।
এখানকার তাঁতশিল্পে উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে শাড়ি ও লুঙ্গির ব্যাপক সুনাম রয়েছে দেশে। এখানকার দ্বিতীয় প্রধান শিল্প হচ্ছে দু্গ্ধশিল্প। বাংলাদেশের বৃহৎতম দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটার সবচেয়ে বড় কারখানাটি শাহজাদপুরে অবস্থিত। এই কারখানায় দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়াও দুগ্ধজাত ঘি, মাখন, আইসক্রিমসহ নানা পণ্যের উৎপাদন হচ্ছে। মিল্টভিটার প্রায় শতকরা আশি ভাগ দুধ শাহজাদপুরে বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের দুগ্ধ খামার থেকে সরবরাহ করা হয়। প্রতিদিন প্রায় ২,৯০,০০০ লিটার দুধ শাহজাদপুরেই উৎপাদন হয়। রাস্তা -ঘাট পাকা করনের ফলে খুব সহজেই খামারিরা তাদের উৎপাদিত দুধ পৌছে দিতে পারছেন নির্ধারিত গন্তব্যে।
অপরদিকে এই জনপদে ফসলি জমি রয়েছে ৪৯,৩৩২ হেক্টর। এই বিশাল মাঠের উৎপাদিত ফসল একসময় রাস্তার অভাবে সময়মত বাজারজাত করতে পারতেন না কৃষক। ফলে উৎপাদিত ফসলের বিরাট একটি অংশ নষ্ট হয়ে যেত। প্রত্যন্ত গ্রামের মধ্যে দিয়ে ডুবো সড়ক বা সাবমার্সেবল রাস্তা হওয়ায় খুব সহজেই কৃষক তাদের ফসল যেমন ঘরে তুলতে পারছেন তেমনি সময়মত বাজারজাত করতে পেরে হাতে পাচ্ছেন নগদ অর্থ।
উপজেলার বিভিন্ন মাঠের বুক চিড়ে নির্মিত কংক্রিটের রাস্তায় বদলে গেছে গ্রামের মানুষের জীবনমান। সবুজ গালিচার উপর গড়ে ওঠা পাকা সড়কের কল্যাণে নতুন দিনের সন্ধান পেয়েছেন শাহজাদপুরবাসী।
সম্প্রতি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার কায়েমপুর, রূপবাটি, গালা, পোতাজিয়া, নরিনা, গাড়াদহ, হাবিবুল্লাহ নগরসহ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে গিয়ে গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়নের চিত্র দেখা যায়। নদী-নালা, বিল-ঝিল বেষ্টিত এসব ইউনিয়নের মানুষের আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা যেন শহরের মতোই।
সম্প্রতি উপজেলার বড়ধুনাইল, বাগ ধুনাইল, রূপবাটি, সদামারা, ভুলবাকুটিয়া, রতনকান্দি, আহম্মদপুর, মোয়াকোলা, আন্ধারমানিক,চর ধুনাইল, করশালিকা, দুগালি,বায়ড়া, শিমুলিয়া, রেশমবাড়ি, মশিপুর, নরিনা গিয়ে দেখা যায় লম্বা কংক্রিটের সড়ক মাঠের পর মাঠ পেড়িয়ে ঢুকে পড়েছে এক চিলতে গ্রামের ভিতর। রাস্তায় চলছে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা, শ্যালো ইঞ্জিন চালিত তিন চাকার বেশ কিছু যানবাহন। এছাড়া রয়েছে যাত্রীবাহী মোটরসাইকেল। কিছু দূর যাবার পর দেখা যায় বিশাল বাজার। বড়ধুনাইল নামে এ জনপদটি যেন প্রত্যন্ত গ্রামে গড়ে ওঠা এক চিলতে শহর। বড়ধুনাইল বাজার থেকে রাস্তাটি চলে গেছে আরও বহুদূর আরেকটি গায়ে। এভাবেই কংক্রিটের সড়কের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে গ্রামাঞ্চলের ইউনিয়নগুলোর আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা।
বড়ধুনাইল বাজার থেকে শাহজাদপুর শহরের দিকে তিন চাকার বেটারিচালিত গাড়িতে আসছিলেন আইনজীবী আলমগীর হোসেন।
জানতে চাইলে আলমগীর হোসেন বলেন, বাবা-দাদার আমল থেকে মাটির রাস্তায় পায়ে হেটে কাদামাটিতে মাখামাখি করে যেতাম শহরে। সময় লাগত ২/৩ ঘন্টা। এখন পাঁকা রাস্তা হওয়ায় ২০/২৫ মিনিটেই পৌছে যাচ্ছি গন্তব্যে।
কথা হয় রতনকান্দি গ্রামের ব্যাবসায়ী ও যুবলীগ নেতা এনামুল হক হিরার সাথে, রাস্তা পাকা হওয়ার আগে আমাদের গ্রামের মানুষের জীবন ছিল দুর্বিসহ।
হটাৎ কেউ অসুস্থ হলে কাধে করে নিতে হতো। গ্রামের কৃষকেরা ফসল তুলতে পারতো না ঠিক মত। এখন কৃষকেরা তাদের সোনার ফসল আয়েশ করে গাড়িতে করে বাড়ি নিয়ে আসেন।
ভুলবাকুটিয়া গ্রামের কলেজ পড়ুয়া ছাত্র জিহাদুল ইসলাম জাহিদ বলেন, একসময় রাস্তা ছিলনা বলে স্কুল থেকেই শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়তো। কারন যানবহন ছাড়া দশ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে কলেজে যাওয়া সত্যি দূরহ ব্যাপার ছিল। এখন রাস্তা হওয়ায় সেই দূরত্ব ঘুচেছে।
এ ব্যাপারে শাহজাদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কৈজুরি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম জানান, গ্রাম হবে শহর- প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণাকে বাস্তবায়ন করতে আমরা কাজ করছি। গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যেও এখন শহরের সুবিধা পৌঁছে গেছে। নতুন নতুন রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে। গত কয়েক বছরে টি-আর কাবিখার বরাদ্দ এবং এলজিইআরডির মাধ্যমে নতুন রাস্তা তৈরি করা হয়েছে এবং নীচু এলাকায় ডুবো রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। এতে করে গ্রামের মানুষ নতুন নতুন কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভাবে সাবলম্বী হয়েছে এবং সার্বিক ভাবে তাদের জীবনমানের উন্নতি ঘটেছে।