আজ ১৭ এপ্রিল শনিবার দিনাজপুরের ফুলবাড়ী ঐতিহাসিক আঁখিরা গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে উপজেলার আলাদীপুর ইউনিয়নের বারাইহাট থেকে ১০০ গজ দূরে আঁখিরা নামক একটি পুকুর পাড়ে বর্বর খান সেনাদের হাতে নিমর্ূমভাবে প্রাণ হারান ভারতে আশ্রয় নিতে যাওয়া ফুলবাড়ী, নবাবগঞ্জ, পার্বতীপুর ও বদরগঞ্জ উপজেলার প্রায় ৫শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু। আজও অনেকে এই ঘটনার বেদনাবিধুর স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন।
ঐত্যিহাসিক স্থানটি তথা এর মর্মান্তিক কাহিনী সম্পর্কে যাতে পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারে সে কারনে এই সৃতি ধরে রাখতে দেশ স্বাধীনের পর থেকে আঁখিরা বধ্যভূমিটি সংরক্ষণসহ সেখানে বীর ওইসব শহীদদের স্মৃতি উদ্দেশ্যে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে একাধিকবার উদ্যোগ নেয়া হলেও শুধুমাত্র অর্থের অভাবে সেই কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বিষয়টি আমলে নিয়ে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর চলতি বছরের জানুয়ারী মাসে অত্র এলাকার সাংসাদ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাড: মো. মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার এমপির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সেই বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণ কাজ শুরু করে গণপূর্ত বিভাগ। যা বর্তমানে চলমান। ভবিষ্যতে আঁখিরা বধ্যভূমিটি সাধারণ মানুষের কাছে স্বরণীয় হয়ে থাকবে।
মুক্তিযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের নিকট জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে ফুলবাড়ী উপজেলার রামভদ্রপুর, নবাবগঞ্জ উপজেলার খোশলামপুর ও পার্বতীপুর উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়নের বাধদিঘী গ্রামের এবং রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ী সংলগ্ন গ্রামগুলোর প্রায় ৫শতাধিক হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী, পুরুষ ও শিশুদের নিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার জন্য চেষ্টা করলে রামভদ্রপুর গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার কেনান সরকার তাদেরকে ভারতে পৌছে দেয়ার কথা বলে তাদের নিকট থেকে সোনা-দানা ও নগদ অর্থ হাতিয়ে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। ৫ শতাধিক মানুষের এই দলটি শিবনগর ইউনিয়নের শিবনগর গ্রামের মধ্য দিয়ে সমশেরনগর গ্রাম হয়ে বারাইহাট পার হয়ে আঁখিরা পুকুরপাড়ে পৌছা মাত্র কুখ্যাত রাজাকার কেনান সরকার ও তার সঙ্গীরা এই নিরীহ মানুষদেরকে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। পাক হানাদার বাহিনী সদস্যরা এই ৫ শতাধিক মানুষকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। ভাগ্যের জোরে বেঁচে যান ওই দলের সহযাত্রী উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের বাসিন্দা রাখাল চন্দ্র (৬২)। তিনি জানান, কুখ্যাত রাজাকার কেনান সরকারের কথায় বিশ্বাস করে যাত্রা শুরু করেছিল ৪ উপজেলার প্রায় ৫শতাধিক মানুষ। কিন্তু তাদের বিশ্বাস এভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে তারা বিন্দুমাত্র বুঝতে পারেননি।
এদিকে আখিঁরা গণ হত্যা বর্ণনা করতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী বারাইহাট বাজারের পল্লী চিকিৎসক অনিল কুমার (৬৭) বলেন এই গণহত্যার সময় তিনি পাশ্বেবর্তী বড়গাছা গ্রামে একটি ঝোপে লুকিয়ে পড়েন। এরপর খান সেনারা চলে গেলে তিনি এসে দেখতে পান শত শত নারী-পুরুষ ও শিশুর গুলি বিদ্ধ মৃতদেহ। এ সময় একটি এক থেকে দেড় বছর বয়সে শিশু তার মৃত্যু মায়ের স্তন পান করছিল বলে তিনি জানান। এরপর অনেক লোক সেখানে এসেছে তাদের মধ্যে কেউ জীবিত বাচ্ছাটিকে নিয়ে গিয়েছেন। একই কথা বলেন আর এক প্রত্যক্ষদর্শী বড়গাছা গ্রামের আব্দুল খালেক, তিনি বলেন বহু দিন পর্যন্ত এই পুকুরটিতে মানুষের হাড় ও মাথার খুলি পড়ে ছিল। সে দিনের সেই স্মৃতি তার চোখের সামনে আজও ভেসে ওঠে।
ফুলবাড়ী উপজেলা সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলী বলেন, ফুলবাড়ীর যে কয়টি ঘৃনিত কু-কর্মের অধিকারী রাজাকার ছিল তাদের মধ্যে কেনান সরকার অন্যতম। সে শুধু ওই ৫শতাধিক ব্যক্তির প্রাণই নেয়নি তার হাতে নিহত হয়েছে ফুলবাড়ীসহ কয়েকটি উপজেলার কয়েক হাজার নিরীহ মানুষ। এ জন্য যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তার মৃত্যু হয়েছে। তার অনেক সঙ্গী এখন ফুলবাড়ী থেকে বিতাড়িত। এই ঐতিহাসিক আখিরা বদ্ধ ভূমিটিতে সৃতি স্তম্ভ নির্মান কার্যক্রম শুরু হওয়ায় তিনি সকল মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে স্থানীয় সাংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাড: মোস্তাফিজুর রহমান এর প্রতি বিশেষ কৃতঙ্গতা প্রকাশ করেছেন।